Select Page
২০১৫-১২-১২
আলোর স্মরণে কাটুক আঁধার – ২০১৫

লিফলেট

২৮ অগ্রহায়ণ ১৪২২/১২ ডিসেম্বর ২০১৫ সন্ধ্যা ৫.২০ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মুক্তিযুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের স্মরণে নারীপক্ষ’র বিশেষ স্বরণ অনুষ্ঠান ‘আলোর স্মরণে কাটুক আঁধার’ নিবেদিত। ১৯৮৮ সাল থেকে প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসে বিজয় দিবসের প্রাক্কালে মুক্তিযুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের স্মরণে বিভিন্ন প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে নারীপক্ষ নিয়মিতভাবে “আলোর স্মরণে কাটুক আঁধার” অনুষ্ঠানটি উদযাপন করে আসছে। এবারের প্রতিপাদ্য “মুক্তিযুদ্ধ, বাকস্বাধীনতা ও বাংলাদেশ”।

এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে ‘আগুনের পরশ মনি ছোঁয়াও প্রাণে’ গানের সাথে সাথে মুক্তিযুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের স্মরণে উপস্থিত সকলে একটি করে আলোর শিখা জ্বালিয়ে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন।
অনুষ্ঠানে ঘোষণাপত্র পাঠ করেন মনীষা মজুমদার। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করেন স্মৃতিচারণ করেন, আলী আহমেদ জিয়াউদ্দিন, শারমীন মোরর্শেদ ও আশরাফুল আলম। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ’র কবিতা ‘কোন এক মাকে’ আবৃত্তি করেন সাজেদা সুমী। ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইরা নিতে চায়’ ও ‘এসো মুক্ত কর অন্ধকারের এই দ্বার’ গান দুটি পরিবেশন করেন পাপড়ি ও তার দল। নারীপক্ষ’র সদস্য কামরুন নাহার-এর ধন্যবাদ জ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হয়। উক্ত অনুষ্ঠানে প্রায় ২০০ জন উপস্থিত ছিলেন।

ঘোষণাপত্র

মুক্তিযুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া মানুষের মুখ আমাদের স্মৃতিতে সর্বদা অম্লান। হারিয়ে যাওয়া সেইসব স্বজনদের স্মরণে প্রতি বছরের মতো এবারও বিজয় দিবসের প্রাক্কালে নিবেদিত হচ্ছে নারীপক্ষর শ্রদ্ধাঞ্জলি ‘‘আলোর স্মরণে কাটুক আঁধার।’’ নারীপক্ষ ১৯৮৮ সাল থেকে প্রতিবছর একটি বিশেষ বিষয়কে তুলে ধরে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে। এবারের বিষয় ‘‘মুক্তিযুদ্ধ, বাকস্বাধীনতা ও বাংলাদেশ।’’

ডিসেম্বর মাস বিজয়ের মাস, আনন্দের মাস, বেদনার মাস। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে আমরা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছি; বিশ্ব মানচিত্রে অঙ্কিত হয়েছে আমাদের অবস্থান। এর জন্য আমাদের অনেক মূল্য দিতে হয়েছে, হারাতে হয়েছে অনেক স্বজন। আপন অস্তিত্বে সদা বিরাজমান সেইসব স্বজনের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে প্রতি বছর আমরা এভাবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সম্মিলিত হই।

আজ আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি নারীপক্ষ’র প্রয়াত সদস্য নাসরীন হককে, যাঁর উদ্যোগে এই অনুষ্ঠানের সূচনা হয়েছিলো। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে তাঁর মতো উদ্যমী ও সাহসী মানুষের প্রয়োজন আজ আমরা বড় বেশী অনুভব করছি।

১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের বীজ বপন হয়েছিলো ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। মানুষের মনের ভাব প্রকাশের অন্যতম ও প্রধান মাধ্যম কথা। যখন কারো চিন্তা-চেতনা এবং অনুভূতি প্রকাশের পথ রোধ করতে হয় তখন সর্বাগ্রে তার কথা বলার অধিকার বা উপায় কেড়ে নেয়া হয়। তৎকালীণ শাসকগোষ্ঠী আমাদের মাতৃভাষা কেড়ে নিয়ে বাক রুদ্ধ করে দিতে চেয়েছিলো কিন্তু স্বাধীনচেতা জনতা তা মানেনি, প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিলো। সেই প্রতিবাদ ১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যুথানে রূপ নেয় তৎকালীন সামরিক শাসক আয়ুবশাহীর নিগ্রহ, অত্যাচার ও জুলুমের বিরুদ্ধে। সেই নিগ্রহ, অত্যাচার, জুলুম প্রতিহত করে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় দেশের মানুষ সোচ্চার হয়েছিল, দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিলো, যার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে এবং আমরা লাভ করি স্বাধীন-স্বার্বভৌম বাংলাদেশ।

আমরা স্বাধীন বাংলাদেশেও প্রতিনিয়ত অধিকারহীনতার শিকার। এরমধ্যে অন্যতম বাকস্বাধীনতার অধিকার।

বাক অর্থাৎ- উক্তি, বাক্য, শব্দ, কথা- যা দ্বারা মানুষ তার চিন্তা, মতামত, আলোচনা-সমালোচনা প্রকাশ করে। আর ‘স্বাধীনতা’ অর্থ বাধাহীনতা, স্বচ্ছন্দতা। সকল ধরনের বাধা বা ভয়ভীতি ছাড়া মনের ভাব, চিন্তা, মতামত, আলোচনা-সমালোচনা প্রকাশ করতে পারাই ‘বাকস্বাধীনতা’।

বাংলাদেশের সংবিধান, যা

৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শেরই প্রতিফলন, কতিপয় মৌলিক অধিকার এবং স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয়, যেমন: জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার, আইনের দৃষ্টিতে সমতা, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা, সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা। আমরা সকলেই এই চেতনা ও আদর্শে বিশ্বাসী।

বাংলাদেশে মানুষের চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা বার বার খর্ব করা হয়েছে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে, নানা আইন-কানুন করে, একদলীয় ও সামরিক শাসন কায়েম করে, সংবাদপত্র ও প্রচারমাধ্যমের কণ্ঠ রোধ করে, মুক্তমনা ও প্রগতিশীল লেখক-সাহিত্যিক-ব্লগার, শিক্ষক, রাজনীতিকদের হত্যা-জখম বা হত্যার হুমকি থেকে রক্ষা ও নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়ে।

বর্তমানে বহুল ব্যবহৃত ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন’ এর ৫৭ ধারার নামেও বাকস্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে। এই আইনের ৫৭ ধারায় বলা হয়েছে: “কোন ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোন ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানি প্রদান করা হয়, তাহা হইলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ।” এখানে অপরাধ হিসেবে যে বিষয়গুলোর কথা বলা হয়েছে তা অস্পষ্ট এবং আপেক্ষিক, যেমন: শ্লীল-অশ্লীল, নীতিভ্রষ্ট, সৎ-অসৎ, উদ্বুদ্ধ হওয়া, ভাবমূর্তি ক্ষুণœ, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত- এই বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ব্যক্তি বিশেষে ভিন্ন হতে পারে, সে ক্ষেত্রে কারো প্রতি আক্রোশ বা বিদ্বেষ প্রসূত হয়ে এই আইনের অপ-প্রয়োগ হতে পারে এবং হচ্ছে। অপরদিকে, ১৯২৬ সালের ‘আদালত অবমাননা আইন’ ২০১৩ সালে নতুনভাবে প্রণীত হয়। যদিও বর্তমানে আদালত এক আদেশে আইনটির কার্যকারিতা স্থগিত করেছে, তথাপি আইনটির প্রয়োগ হয়েই যাচ্ছে। এই আইনের কারণে আদালত অবমাননা হতে পারে এই আশঙ্কায় সাধারণ মানুষ আদালত সংক্রান্ত কোন কথা বলতে আশঙ্কিত।

এই পরিস্থিতি দেশের গণতান্ত্রিকতা এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষাকে নস্যাৎ করছে। দেশে যেন অসহিষ্ণুতার জোয়ার বইছে! এই অবস্থা অনভিপ্রেত এবং অত্যন্ত ক্ষতিকর। এই সীমাহীন ক্ষতি রুখতে হলে রাষ্ট্রের সর্বস্তরে ও সর্বক্ষেত্রে ন্যায়বোধ প্রতিষ্ঠা এবং সহিষ্ণুতার সংস্কৃতি তৈরি করা একান্ত প্রয়োজন। ন্যায়বিচার ও আইনের শাসনের জন্য কথা বলা বাকস্বাধীনতারই অংশ এবং বাকস্বাধীনতা প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার। আসুন, এই অধিকার প্রতিষ্ঠায় আমরা প্রত্যেকে সচেষ্ট হই। নিজ নিজ অবস্থান থেকে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করি এবং অন্যের উদ্যোগে সামিল হই।

মুক্তিযুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের স্মরণে আজ আমরা এখানে মোমবাতির যে আলো জ্বেলেছি তা মানুষের মনের সকল অন্ধকার, কুপমন্ডুকতা ও সঙ্কীর্ণতা দূর করে চিন্তা-চেতনাকে উদার ও প্রসারিত করুক, সত্য ও ন্যায় বলা এবং তা গ্রহণের সাহস যোগাক। প্রত্যেকে প্রত্যেকের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে নিজের মতামত প্রকাশ ও অপরের মতামত বা সমালোচনা শোনার মানসিকতা তৈরি করুক।

স্থান : কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার
দিন-ক্ষণ : শনিবার, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪২২/১২ ডিসেম্বর ২০১৫, সন্ধ্যা ৫:
৩০ থেকে ৬:৩০

Pin It on Pinterest

Share This