Select Page
২০২২-১১-০৬
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন, ২০০৩ একটি পর্যালোচনা
প্রথম সংস্করণে,
পর্যালোচনার কাজটি সমন্বয় করেছেন –

নারীপক্ষ’র সদস্য
ইউ.এম. হাবিবুন নেসা, আইনজীবীসহযোগিতা করেছেন –
নারীপক্ষ’র কর্মী

কামরুন নাহার, আইনজীবী
ফেরদৌসী আখতার, আইনজীবী
বদরুননেছা খুকু, আইনজীবী
শাহ্তাব হোসেন খান, আইনজীবী
সারওয়ার হোসেইন বাপ্পী, আইনজীবী
মুহাম্মদ শফিকুর রহমান, আইনজীবী এবং
নারীপক্ষ’র সদস্য
শামসুন নেসা, শিরীন হক, ফজিলা বাণু লিলি
ও রীনা সেন গুপ্তাপ্রথম প্রকাশ:ভাদ্র, ১৪০৮/ আগষ্ট, ২০০১ কার্তিক
দ্বিতীয় সংস্করণে
পর্যালোচনার কাজটি সমন্বয় করেছেন –
নারীপক্ষ’র সদস্য রীতা দাশ রায়

সহযোগিতা করেছেন –
নারীপক্ষ’র সদস্য

কামরুন নাহার, আইনজীবী
গীতা দাস এবং
নারীপক্ষ’র কর্মী
শাহানাজ আক্তার, আইনজীবীকম্পিউটার সহযোগিতায় –
মোঃ আজাদ হোসেন
দ্বিতীয় প্রকাশ:
কার্তিক, ১৪১৫/ নভেম্বর,২০০৮

বি: দ্র: পর্যালোচনাটিতে ব্যবহৃত আইনের ভাষা প্রয়াত আইনজ্ঞ গাজী শামছুর রহমান কর্তৃক বাংলা ভাষায় অনুদিত দন্ডবিধি ১৮৬০ এবং বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ কর্তৃক বাংলা ভাষায় প্রণীত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন ২০০৩, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ ও নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ বিধান) আইন, ১৯৯৫ থেকে নেয়া।



পূর্বকথা

নারীপক্ষ নারীর অবস্থা উন্নয়ন ও নারীর অধঃস্তন অবস্থান পরিবর্তনের লক্ষ্যে গঠিত একটি সদস্যভিত্তিক সংগঠন। নারীর ব্যক্তি অধিকার নিশ্চিত করা ও নারীর প্রতি সহিংসতা ও সকল প্রকার বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার লক্ষ্যে নারীপক্ষ কাজ করে যাচ্ছে। ১৯৮৩ সালে নারীপক্ষ’র প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে প্রতি মঙ্গলবার সাপ্তাহিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। মঙ্গলবারের আলোচনার ধারাবাহিকতার উপর ভিত্তি করেই নারীপক্ষ’র বিভিন্ন কার্যক্রম গড়ে উঠেছে; যেমনঃ প্রতিবাদ কর্মসূচি, প্রচারণা, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড, গবেষণা, নারী অধিকার সংক্রান্ত নীতিমালাকে প্রভাবিত করা, প্রশিক্ষণ ও বিভিন্ন বিষয় ভিত্তিক আলোচনা সভা ও সম্মেলনের আয়োজন ইত্যাদি।

নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ আন্দোলনকে আরো শক্তিশালী করার জন্য নারীপক্ষ এ বিষয়ে গবেষণার করেছে। দুই বছর ব্যাপী নারী নির্যাতন, বিশেষতঃ গৃহে নারীর প্রতি সহিংসতা বিষয়ে গবেষণা করা হয়েছে। নারী নির্যাতন বিষয়ে দ্রুত সমীক্ষার (Rapid Assessment) প্রতিবেদনও তৈরী করা হয়েছে। এছাড়া নারীপক্ষ ১৯৯৬ সাল থেকে এসিড দগ্ধ মেয়েদের ও তাদের পরিবারকে মানসিক, সামাজিক, ডাক্তারী চিকিৎসা ও আইনগত সহায়তা পেতে সহযোগিতা দিয়ে আসছে।

নারীপক্ষ রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ড অর্থাৎ অপরাধ বা নির্যাতনের ঘটনা তদন্ত, নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিকে মানসিক সাহায্য প্রদান, চিকিৎসা ব্যবস্থা ও আদালতে বিচার প্রক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত কর্মীদের দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যক্তিগত আচরণ নিয়মিত পরিবীক্ষণ করার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে ১৯৯৮ সালে ”নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ড পরিবীক্ষণ” নামে একটি গবেষণাধর্মী প্রকল্প হাতে নেয়। এ প্রকল্পের মাধ্যমে নারীপক্ষ আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, স্বাস্থ্য বিভাগ ও বিচার বিভাগের সাথে একযোগে কাজ করে আসছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সমূহের কার্যকলাপ ও কার্যপদ্ধতির মধ্যে স্থায়ী ও গুনগত পরিবর্তন সৃষ্টি করার লক্ষে পরিবীক্ষণের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যসমূহ নিয়মিতভাবে এই সকল প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের কাছে উপস্থাপন করা হয়। সংলাপের মাধ্যমে এই সকল প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকার কার্যকর ভূমিকা পালনে সীমাবদ্ধতা উত্তরনে সম্ভাব্য সমাধানের সুপারিশ করা হয়। বর্তমানে নারীপক্ষ’র উদ্ভাবিত পরিবীক্ষণ কৌশল ২০টি জেলায় সহযোগী সংগঠনের মাধ্যমে থানা, হাসপাতাল ও আদালতের সাথে সংশিস্নষ্ট সেবা প্রদানকারী ব্যক্তিদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে ব্যবহার করা হচ্ছে। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে প্রতিবন্ধকতার স্পষ্ট ধারণা পেতে অভিযুক্ত ব্যক্তির মনোভাব ও দৃস্টিভঙ্গি সম্পর্কে জানতে গবেষণা করা হচ্ছে।

সরকার কর্তৃক প্রণীত নারীর প্রতি নির্যাতন রোধে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০’ প্রণয়ন কালে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা সংস্থা বিভিন্ন নারী ও মানবাধিকার সংগঠন এবং ব্যক্তিবর্গ নিয়ে আইনটির খসড়া পর্যালোচনা করেন। এ প্রক্রিয়ায় নারীপক্ষ যুক্ত ছিল ও মতামত প্রদান করেছে। এছাড়াও ২০০০ সালের আইনটির আইনগত ব্যাখ্যা ও আইনের প্রয়োগ বিষয়ে বিচারকাজে নিয়োজিত ব্য&&ক্তদের নিকট থেকে সংগৃহীত সুপারিশমালা আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, আইন কমিশন ও প্রধানমন্ত্রীর মূখ্য সচিবের দফতরে প্রেরন করা হয়েছে। নারীপক্ষ ১৯৯৮ সালে ”১৯৯৫ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ বিধান) আইন ও নতুন আইনের খসড়া বিল ১৯৯৮” এর উপর একটি পর্যালোচনা প্রকাশ করেছে।

পাঠকের জন্য :
নারী ও শিশু নির্যাতন রোধ করতে বাংলাদেশ সরকার এ যাবৎ বেশ কিছু আইন প্রণয়ন করেছেন এবং দন্ডবিধিতে এ সংক্রান্ত বিধান পূর্ব থেকেই প্রচলিত ছিল। প্রণীত ও প্রচলিত আইনগুলো কতখানি যুগোপযোগী ও বাস্তবে প্রয়োগযোগ্য তা খতিয়ে দেখার জন্য উল্লেখযোগ্য তিনটি আইন,যথাক্রমে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০, নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ বিধান) আইন, ১৯৯৫ এবং দন্ডবিধি ১৮৬০ এর তুলনামূলক একটি আলোচনা ও পর্যালোচনা এ পুস্তকে করা হয়েছে। আমরা আশা করি বাংলা ভাষায় প্রস্ত্তুতকৃত এই পর্যালোচনাটি পূর্বে প্রচলিত আইন ও এর প্রয়োগ এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর প্রয়োগ ও বিধান সম্পর্কে একটি ধারণা দেবে। শুরুতে ভূমিকার পর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ জনগণের জন্য কতটুকু সহায়ক এ সম্পর্কে নারীপক্ষ’র আলোচনা রয়েছে। এরপর তিনটি আইনের ধারা অনুযায়ী আইনসমূহের শিরোনাম, সংজ্ঞা ও আইনের প্রাধান্যের কথা বলা হয়েছে। এরপর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর অপরাধ ও শাস্তির আলোকে পূর্বে বলবৎকৃত নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ বিধান) আইন, ১৯৯৫ ও দন্ডবিধি ১৮৬০ সংশ্লিষ্ট ধারাসমূহ সংজ্ঞা ও শাস্তি সহকারে উল্লেখিত হয়েছে। এ ছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইনের প্রত্যেকটি ধারার অপরাধ ও শাস্তির আলোকে নারীপক্ষ’র নিজস্ব মন্তব্য রয়েছে। সবশেষে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের অধীনে এ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত ১০টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল এর মধ্যে ৯টি ট্রাইব্যুনালে ডিসেম্বর ২০০০ পর্যন্ত দায়েরকৃত মামলার একটি পরিসংখ্যান ও অবস্থার সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে। আমরা আশা করি পর্যালোচনাটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমনে নতুন নতুন আইনের প্রয়োজনীয়তা ও প্রয়োগযোগ্যতা কতটুকু সে সম্পর্কে ধারণা দেবে।

সৈয়দা রম্নবী গজনবী
আহ্বায়ক
নারীপক্ষ

দ্বিতীয সংস্করণে আমাদের কিছু কথাঃ

বাংলাদেশ সরকার নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে সর্বশেষ যে আইন প্রনয়ণ করেছে তা হরো ”নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন, ২০০৩”। নারীপক্ষ ২০০১ সালে ”নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০” শিরোনামে একটি পর্যালোচনা প্রকাশ করেছে। পর্যালোচনাটি সারা দেশের সবগুলো পুলিশ ষ্টেশন, নারীপক্ষ’র ৫৫০টি সহযোগী সংগঠন এর মাধ্যমে সরকারী আইনজীবী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে প্রেরিত হয়েছে। পর্যালোচনাটির ব্যাপক চাহিদা ও প্রগণযোগ্যতা পরিলক্ষক্ষত হচ্ছে। ”নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন, ২০০৩” প্রণীত হলে তা পর্যালোচনাটির সাথে সংশোধনীগুলো সংযোগ করে ”নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন, ২০০৩” শিরোনামে একটি পর্যালোচনা দ্বিতীয় সংকরণ হিসেবে প্রকাশ করা হল।

দ্বিতীয় সংস্করণে ৬টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালত থেকে নারীপক্ষ’র সহযোগী সংগঠন কর্তৃক সংগৃহীত ২০০৭ সালে দায়েরকৃত মামলার পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়েছে। আমরা আশা করি পর্যালোচনাটি পূর্বের মতই নারী ও শিশু নির্যাতন দমনে আইনের প্রয়োগযোগ্যতা ও প্রক্রিয়া সম্পর্কে সীমাবদ্ধতা উত্তরণে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।

বেগম শামসুন নাহার
আহ্বায়ক
নারীপক্ষ

নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা রোধকল্পে প্রণীত
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন)আইন, ২০০৩ এর সঙ্গে
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ বিধান) আইন,
১৯৯৫ ও দন্ডবিধি ১৮৬০ এর সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন
ধারাসমূহের একটি তুলনামূলক পর্যালোচনা।

 

মন্তব্য (সার্বিক) নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ কতটা প্রয়োগযোগ্য :
ইতিবাচক দিকঃ
নেতিবাচক দিকঃ
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন)আইন, ২০০৩ এর ভিত্তিতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০, নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ বিধান) আইন, ১৯৯৫ ও দন্ডবিধি এর তুলনামুলক আলোচনাঃ

ভূমিকা

বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতামূলক অপরাধ সংক্রান্ত আইন ও বিধি বিধান দন্ডবিধির আওতায় আছে। তারপরেও বিভিন্ন সময় নারী নির্যাতন বিষয়ে বিশেষ বিশেষ আইন প্রণীত হয়েছে। যে কোন বিশেষ সমস্যা সমাধানের জন্য প্রণীত হয় বিশেষ আইন ও বিধি। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন, ২০০৩ জারী করার পূর্বে যে সব আইন বলবৎ ছিল সেসব আইনগুলোতে কোন্ ধরনের অপর্যাপ্ততার কারণে নূতন আইনের প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল সে বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট পর্যালোচনা এপর্যন্ত হয়নি। নারীর প্রতি সুবিচার এবং নারীর প্রতি সহিংসতামূলক অপরাধের বিচার ও অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে বিশেষ আইন প্রণয়ন কতটুকু অবদান রাখতে পারে তার একটি ধারণা লাভের জন্য এবং নারীর প্রতি সহিংসতা সংক্রান্ত প্রচলিত ও বিলুপ্ত আইনগুলোর নির্দিষ্ট ধারা নিয়ে একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরার জন্য নারীপক্ষ এ পর্যালোচনাটি প্রকাশ করেছে।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ গত ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০০০ সালে প্রণীত হয়। বাংলাদেশে এ নুতন আইন প্রণীত হওয়ার সাথে সাথে নারী নির্যাতনের নির্দিষ্ট কয়েকটি অপরাধ বিষয়ে বিদ্যমান অন্যান্য আইন সমূহের উপর উক্ত আইন প্রাধান্য পায়। ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ধারা ৩৪ এর বলে নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ বিধান) আইন, ১৯৯৫ বিলুপ্ত করা হয়। ১৯ জুলাই ২০০৩ তারিখে ”নারী ও শিশু নির্যাতন দমন(সংশোধন) আইন, ২০০৩” প্রনীত হবার পর থেকে ২০০০ সালের আইনটির শিরোনাম পরিবর্তিত হয়। পরিবর্তিত আইনে ১০টি ধারা সংশোধন করে ২০০০ সালের আইনটিকেই বলবৎ রাখা হয়।

আমরা প্রতিনিয়ত নারীর প্রতি সহিংসতার যে সব ঘটনা পর্যবেক্ষণ করি তা আমাদের বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন করে, তবুও সমস্যাগুলোকে ”বিশেষ অবস্থা” বলে আখ্যায়িত করা কতটা যুক্তিযুক্ত তা প্রশ্নের দাবী রাখে। সমাজে নারী -পুরুষ সম্পর্কের অসমতা এবং পরিবারে, সমাজে ও রাষ্ট্রে নারীর অধঃস্তন অবস্থানের কারণেই বিভিন্ন ধরণের সহিংসতা হচ্ছে। যে সংস্কৃতিতে নারীকে বিভিন্ন ভাবে হেয় করা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে; নারীর চরিত্রের উপর আক্রমণ প্রতিবাদের কোন বিষয়ই না; নারীর শরীর ও যৌনতার প্রতি আঘাত প্রতিবাদের চাইতে নিন্দার কারণ হয়ে দাঁড়ায়; – সেই প্রেক্ষাপটে নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে আইনের ভূমিকা কতটুকু? নারীর প্রতি আঘাতের পরিমাণ যখন গুরুতর অবস্থায় গিয়ে দাঁড়ায় এবং তা আর যখন চার দেয়ালের মধ্যে সীমিত না থেকে যেকোন ভাবে বাইরে বেরিয়ে পড়ে, তখনই কেবল মাত্র আইনের ভূমিকার প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। এহেন হেয় প্রতিপন্নতা ও গুরুতর আঘাত এর মধ্যে যেমন কোন পার্থক্য নেই, অপরাধ সংঘটনকারীদের মধ্যেও তেমনি পার্থক্য নেই; অর্থাৎ কাছের/দূরের আত্মীয়/অনাত্মীয় সব ধরণের মানুষ এ অপরাধ ঘটাচ্ছে। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ ও প্রতিকার বহুমাত্রিক প্রচেষ্টার মাধ্যমেই সম্ভব। আইন একটি মাত্র উপায়, তথাপিও এর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

দন্ডবিধির যথাযথ প্রয়োগ হলে, অর্থাৎ গোটা ফৌজদারী বিচার ব্যবস্থাকে সচল এবং সুষ্ঠু করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাদি গ্রহণ করা হলে, এ আইনগুলোই অপরাধ দমনে অধিকতর কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারতো। তা না করে নতুন নতুন আইন প্রণয়ন করে আইন প্রয়োগের কাঠামোগত সমস্যা ও ব্যর্থতা থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব কি? সমাজপতিরা যেমন কিছু সংখ্যক অপরাধকে চিহ্নিত করেই সামাজিক দায়িত্ব শেষ করতে চান; ঠিক তেমনি রাষ্ট্রও নিত্য নতুন আইন প্রণয়নের মধ্য দিয়েই দায়িত্ব সম্পাদনের চেষ্টা করেন। এর প্রায়োগিক দিক অর্থাৎ আইন কিভাবে প্রয়োগ করলে অপরাধ দমনে কার্যকর ভূমিকা রাখবে সে বিষয়ে রাষ্ট্র যথেষ্ট সচেষ্ট নয়।

২০০০ সালের নুতন আইনটির খসড়া প্রণয়ন করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা সংস্থার উদ্যোগে বিভিন্ন নারী সংগঠনের সমন্বয়ে সুপারিশমালা প্রস্ত্তত করা হয়। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই যে, উক্ত আইনে নারী সংগঠনগুলোর মতামতের প্রতিফলন অনেকাংশেই হয়নি।

নারী নির্যাতনের সঠিক বিচারের ক্ষেত্রে আদালতের ভূমিকা অগ্রগণ্য। অপরাধ প্রমাণের ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকায় থাকে বিভিন্ন তথ্য যেমন : এজাহার, ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬১ ধারায় পুলিশ কর্তৃক গৃহিত বক্তব্য, ১৬৪ ধারায় ম্যাজিষ্ট্রেট কর্তৃক গৃহিত বক্তব্য, চিকিৎসক কর্তৃক প্রদেয় সনদপত্র, অভিযোগপত্র ইত্যাদি। মামলার বিচারকার্যে এ সমস্ত প্রমানাদির মধ্যে অসামঞ্জস্য দেখা দিলে অপরাধ প্রমান করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। উপরন্তু সাক্ষ্য প্রমান সরবরাহকারী সংস্থাসমূহের যোগ্যতা, দক্ষতা, সততা ইত্যাদি প্রশ্নাতীত নয় বলেই মামলার সুষ্ঠু বিচার অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যাহত হচ্ছে এবং অপরাধী খালাস পেয়ে যাচ্ছে।
অতএব অপরাধ দমনে অপরাধ প্রমাণ হওয়া একান্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং অপরাধ প্রমাণ হয় শুধুমাত্র আইনের বিধান যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে; সুতরাং এ কথা অনস্বীকার্য যে নিত্য নতুন আইন প্রনয়নের চেয়ে আইনের প্রয়োগ অধিক গুরুত্বপূর্ণ।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন, ২০০৩ : প্রায়োগিক দিক
ইতিবাচক দিক

  • এ আইনে মামলার তদন্ত ও বিচারের জন্য সময় নির্ধারিত আছে, এর যথাযথ প্রয়োগ হলে দ্রুত তদন্ত ও বিচার কার্য সম্পন্ন হওয়া সম্ভব। বিশেষ করে নির্ধারিত সময়ে তদন্ত করতে ব্যর্থ হলে তদন্ত কর্মকর্তার দায়িত্বে অবহেলা ও এ কারণে তদমেত্মর দায়িত্ব অন্য কর্মকর্তার উপর বর্তাবে এ বিষয়টি তদন্ত কর্মকর্তাদের সক্রিয় করে তুলবে। ফলে মামলার দীর্ঘসূত্রীতা কমতে পারে।
  • নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ বিধান) আইন, ১৯৯৫ এর মত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন(সংশোধন) আইন, ২০০৩ এও মামলার তদন্ত কালের সময় বৃদ্ধির বিষয়টি সরাসরি ট্রাইব্যুনালের বিবেচনাধীন। অর্থাৎ সময়সীমা বৃদ্ধির বিষয়টি মামলার বিচারকের বিবেচনাধীন। এতে মামলার তদন্ত প্রক্রিয়া দ্রুত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
  • বিশেষ ট্রাইব্যুনালকে একটানা এবং শুধুমাত্র এ আইনের অধীন অপরাধের বিচারকার্য পরিচালনার লক্ষ্যে বিশেষ দায়িত্ব দেয়ার ফলে মামলাগুলির দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া সম্ভব।
  • দন্ডবিধিতে অপরাধের ব্যাপক বিধান থাকলেও কিছু অপরাধকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন(সংশোধন) আইন, ২০০৩ এ নির্দিষ্ট করার ফলে উক্ত অপরাধগুলো দমনে এ আইন কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে।
  • যৌতুকের সংজ্ঞাকে স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে। পূর্বে বরপক্ষ কর্তৃক দাবীকৃত পণকে যৌতুক হিসাবে ধরা হত এখন কনেপক্ষ কর্তৃক দাবীকৃত পণকেও যৌতুক হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।
  • সংশোধন আইন ২০০৩-এ কোনব্যক্তি যৌতুক দাবী করে সাধারণ জখম করলে অনধিক ৩ বছর এবং অন্যুন ১ বছর সশ্রম কারাদন্ডে ও গুরুতর জখম করলে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ড এবং অন্যুন ৫ বছর সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডনীয় হবেন। কিন্তু পূর্বে আহত করার চেষ্টা করা হলে অনূন্য ৫ বছর কারাদনড প্রদান করা হত-যেটা অপরাধের তুলনায় বেশী বলে মনে হয়।
  • যেক্ষেত্রে অপরাধী উপার্জনক্ষম, সেক্ষেত্রে অপরাধীর নিকট থেকে জরিমানা আদায় করার বিধানটি প্রয়োগযোগ্য হতে পারে। যেমন, প্রতিদিন পত্রিকায় অনেক ঘটনা পাওয়া যায় যেখানে গৃহপরিচারিকা বা একটি দরিদ্র বা ক্ষমতাহীন নারী গৃহকর্তা বা ক্ষমতাশালী ব্যক্তির দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়, এসব অপরাধের ক্ষেত্রে জরিমানা আদায়ের বিষয়টি কার্যকর হতে পারে।
  • অতীত কাল থেকে মিথ্যা মামলা দায়ের করে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার একটি প্রবণতা চলে আসছে। কখনো কখনো অভিভাবক/ আত্মীয়-স্বজন/ ক্ষমতাবানের চাপে পড়ে অনেক নারীই মিথ্যা মামলা দায়ের করতে বাধ্য হয়। এ আইনের যথাযথ প্রয়োগে এধরণের সমস্যার সমাধান হতে পারে ও মিথ্যা মামলা দায়ের কমতে পারে।
  • এ আইনে ‘রুদ্ধদ্বার কক্ষে বিচার’ এর সুবিধা রয়েছে অর্থাৎ বিচারক শুধুমাত্র মামলার পক্ষদ্বয় ও তাদের নিয়োজিত আইনজীবীদের নিয়ে বিচার পরিচালনা করতে পারেন। সেক্ষেত্রে অন্য কোন ব্যক্তি উক্ত স্থানে উপস্থিত থাকতে পারবে না। প্রয়োজনে বিচারক এ বিচারকার্য আদালতের মধ্যে বা অন্য কোন স্থানে পরিচালনা করতে পারেন। বর্তমান আইনে বিধানটির উল্লে¬খ থাকার কারণে এ পদ্ধতির ব্যবহারে যৌন নির্যাতনের শিকার নারীরা উপকৃত হতে পারেন। উল্লে¬খ্য এ আইন অনুযায়ী নির্যাতনের শিকার ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ কোন আইনজীবী দায়িত্ব নিলে নির্যাতনের শিকার ব্যক্তি মানসিক ভাবে অনেক বেশী সাহস ও শক্তি পাবে -যা এ উদ্দেশ্যকে সফল করতে পারবে।
  • এ আইন অনুযায়ী পুলিশ যদি অভিযোগ গ্রহণ না করে সেক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল সরাসরি বিচারের জন্য অভিযোগ নিতে পারেন। এ বিধানের বাস্তব প্রয়োগ জনগণের বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে।
  • এ আইনের ধারা ২০(৭) এর অধীনে যদি কোন শিশু অপরাধ সংঘটনের অভিযোগে অভিযুক্ত হয় তাহলে উক্ত শিশুটির বিচারের ক্ষেত্রে ১৯৭৪ সালের শিশু আইন এর বিধানাবলী যথাসম্ভব অনুসরণ করে বিচারকার্য সম্পন্ন করার নির্দেশ রয়েছে। সুতরাং এ বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে অপরাধী শিশুটির পিতামাতা বা অভিভাবকগণ কিভাবে বিচার হয়েছে তা সহজে বুঝতে পারবেন।
  • নতুন আইনে ৯ক ধারা সংযোজন করা হয়েছে-যেখানে নারীর আত্মহত্যার প্ররোচনার শাস্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
  • নতুন আইনে অশোভন অঙ্গ ভঙ্গি করার জন্য শাস্তির বিধানটি বাদ দেয়া হয়েছে। একদিকে অশোভন অঙ্গভঙ্গি প্রমান করা যেমন কঠিন অন্যদিকে অনেক নিরাপরাধ ব্যক্তিকে মামলা করে হয়রানি করা হত।
  • সংশোধনী অনুসারে ধর্ষণের ফলে জন্মলাভকারী সমতানকে সরাসরি ধর্ষকের কাছ থেকে ভরণপোষণ আদায় করতে হবে না। ঐ সমত্মানের ভরণপোষণের দায়িত্ব রাষ্ট্র্ বহন করবে এবং রাষ্ট্র্ বিধিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে ধর্ষকের কাছ থেকে অর্থ আদায় করবে।
  • সংশোধিত আইনে ”এই আইনের অধীন সকল অপরাধ অজামিন যোগ্য হইবে”-বিধানটি বিয়োজন করার ফলে অভিযুক্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে ন্যায় বিচার পাওয়ার পথ প্রশস্থ হয়েছে।
  • নিরাপদ হেফাজতে থাকার ব্যাপারে ট্রা্ইব্যুনাল নারী ও শিশুর মতামত বিবেচনায় আনবেন -এ বিষয়টি উল্লেখ করাতে বিচারক ও নিরাপদ হেফাজতি উভয়েই উপকৃত হবে।
  • তদন্ত ও বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিচারকার্য সম্পন্ন না করতে পারলে সুপ্রীম কোর্ট ও সরকারের কাছে কারণ উল্লেখ করে ৩০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন পাঠাবে । সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জবাবদিহিতার বিধানটি মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে সহায়তা করবে।
  • অপরাধের শিকার ব্যক্তির মেডিকোলিগ্যাল পরীক্ষা সম্পন্ন করার এখতিয়ার সরকারী হাসপাতালের পাশাপাশি স্বীকৃত বেসরকারী হাসপাতালকে দেবার ফলে দ্রুততার সাথে সম্পন্ন করা সম্ভব হবে এবং মামলার আলামত নষ্ট হবে না যা নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিকে ন্যায় বিচার পেতে সাহায্য করবে।
  • নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ ও সংশোধন ২০০৩ অনুযায়ী ক্ষয়কারী, বিষাক্ত বা দাহ্য পদার্থ দ্বারা আঘাতের ফলে মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টা এবং ধর্ষনের চেষ্টা, এ উভয় অপরাধের ক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার নারীর প্রতি ‘নির্যাতনের চেষ্টা’ অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
  • ২০০০ সালে নারী শিশু নির্যাতন দমন আইনে নিরাপদ হেফাজতে রাখার বিধান আছে কিন্তু সেখানে নিরাপদ হেফাজতির মতামত বিচারক বিবেচনায় আনবেন কিনা সে বিষয় কিছু উল্লেখ করা ছিল না কিন্তু ২০০৩ সালের সংশোধন আইনের ২০ ধারার ৮ নং উপধারায় নিরাপদ হেফাজতে রাখা আদেশ প্রদানের ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল নিরাপদ হেফাজতি নারী ও শিশুর মতামত বিবেচনায় আনবেন এই বিধানটি বিচার প্রক্রিয়ায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

 

Pin It on Pinterest

Share This