Select Page
২০২২-১১-০৫
ক্যান্সার

আমাদের শরীর অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কোষ দিয়ে তৈরী। এরকম অনেকগুলো কোষ মিলেই আমাদের শরীরে বিভিন্ন টিস্যু আর গ্রন্থি তৈরী। এগুলি প্রত্যেকটিরই, যেমন: মস্তিষ্ক্, যকৃত, ফুসফুস ইত্যাদির নির্দিষ্ট কিছু কাজ আছে। এই কোষগুলো একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর মারা যায়। এই পুরনো কোষগুলোর জায়গায় নতুন কোষ এসে জায়গা করে নেয়। কোষগুলি সাধারণতঃ নিজেদের মধ্যে বিভক্ত হয়ে তাদের বৃদ্ধি ঘটায়। এই বৃদ্ধি একটি স্বাভাবিক, নির্দিষ্ট ও নিয়মিতভাবে সংগঠিত হয়। এই বৃদ্ধির মাধ্যমে আমাদের শরীরের টিস্যুগুলির বৃদ্ধি ও ক্ষয়পূরণ হয়।

কোনো কোনো সময় দেখা যায়, এই কোষগুলো অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়তে থাকে, তখন শরীরের কোনো অংশ অস্বাভাবিকভাবে ফুলে উঠে। ত্বকের নিচে মাংসের দলা অথবা চাকা দেখা যায়। কোনো কলার ভিতরে কোষের সংখ্যাধিক্যকে বলা হয় হাইপারপ্লাসিয়া (hyperplasia)।

তখন সাধারণভাবে এই কোষ দ্বারা গঠিত পিণ্ডকে টিউমার বলা হয়। চিকিৎসাশাস্ত্রে মূলত অনিয়ন্ত্রিতভাবে বিভাজনক্ষম হয়ে বৃদ্ধি পাওয়া কলাকে নিয়োপ্লাসিয়া (neoplasia) বা টিউমার (Tumor) বলা হয়। আর এইরকম কোষগুলোকে নিয়োপ্লাস্টিক কোষ বলে।

টিউমারের কোষগুলোর আচরণগত বৈশিষ্ট্যের বিচারে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। এই ভাগ দুটো হলো―

বিনাইন (Benign) : বিনাইন টিউমার একটা নির্দিষ্ট জায়গায় সীমাবদ্ধ থাকে। এই টিউমারের কোষগুলো আশেপাশের কলার কোষগুলোকে ভেদ করতে না । ফলে এই টিউমার শরীরে ব্যাপকভাবে ক্ষতি করতে পারে না। চিকিৎসা বা প্রয়োজনে অস্ত্রোপচারের দ্বারা এই জাতীয় টিউমার শরীর থেকে অপসারিত করা যায়।

ক্যান্সার (Cancer) বা Mailignant টিউমার : এই জাতীয় টিউমারের বিকৃত কোষগুলো, পার্শ্ববর্তী কোষগুলোকে বিকৃত করে তোলে। কোষের ক্রমাগত পরিবর্তনের ফলে শরীরের বিভিন্ন কলা তার স্বকীয় বৈশিষ্ট্য হারায়। এইভাবে একরকম কলা তার স্বকীয় বৈশিষ্ট্য হারিয়ে অন্য রকম কলায় পরিবর্তিতত হলে, তাকে বলা হয় মেটাপ্লাসিয়া (metaplasia)। মূলত অনিয়ন্ত্রিতভাবে বিভাজনক্ষম এবং ভেদন ক্ষমতাযুক্ত টিউমারকেই ম্যালিগ্ন্যান্ট বা ক্যান্সার বলা হয়।

ম্যালিগ্ন্যান্ট টিউমারের কোষগুলো ক্রমাগত পার্শ্ববর্তী কোষগুলোকে সংক্রমিত করে এবং শরীরের কোনো সুনির্দিষ্ট স্থানে পিণ্ডাকারে না থেকে, সমগ্র শরীরে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে ও জীবন বিপন্নের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এবং শেষ পর্যন্ত প্রাণীর মৃত্যু ঘটায়। অনেক সময় শরীরে এই সংক্রমণ হয় স্থানিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। আবার রক্ত-প্রবাহের দ্বারা শরীরের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

ক্যান্সারের কারণ : ক্যান্সার হওয়ার যথার্থ কারণ কি, এ নিয়ে মতভেদ আছে। তবে সাধারণ কিছু বিষয়কে ক্যান্সার তৈরির কারণ হতে পারে বলে মনে করা হয়। যেমন-
বয়স: বয়স বৃদ্ধির জন্য রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। এর ফলে কোষসমূহ স্বাভাবিক ক্ষমতা হারায় এবং টিউমার তৈরির সম্ভাবনা দেখা দেয়। সাধারণভাবে শতকরা ৬০-৭০ ভাগ ক্ষেত্রে বয়স্ক মানুষের ক্যান্সার দেখা দেয়।

খাবার এবং জীবন-যাপনের ধারা : খাবার এবং জীবনযাপনের ধারার সাথে ক্যান্সারের গভীর সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন গবেষকরা। যেমন― ধুমপান বা মদ্যপানের সাথে ফুসফুস, মুখ ও কণ্ঠনালীর এবং যকৃত বা লিভারের ক্যান্সারের যোগাযোগ রয়েছে। তেমনই ভাবে পান-সুপারি, জর্দা, মাংস, অতিরিক্ত লবণ, চিনি ইত্যাদি খাবারের সাথেও ক্যান্সারের যোগসূত্র রয়েছে।

পরিশ্রম বিমুখতা : যারা সাধারণত শারীরিক পরিশ্রম কম করে তাদের মধ্যেও ক্যান্সারের প্রবণতাটা বেশি।

পারিবারিক ইতিহাস : ক্যান্সারের সাথে জিনগত সম্পর্ক রয়েছে বলেও প্রমাণ পাওয়া গেছে। এই কারণে পরিবারের কারো যদি ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা থাকে তাহলে অন্যদেরও ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেকখানি বেড়ে যায়।

পরিবেশ এবং পেশাগত কারণ: রাসায়নিক পদার্থের সাথে ক্যান্সারের অনেক বড় একটা সম্পর্ক রয়েছে। যেমন, মেসোথেলিওমিয়া-তে (এক ধরনের দূর্লভ ক্যান্সার, এতে ফুসফুসের চারপাশ এবং পেটের দিকের কোষগুলো আক্রান্ত হয়) আক্রান্তদের ১০ জনের মধ্যে ৯ জনই এসবেস্টস ধাতুর সংস্পর্শে আসার কারণে এই ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন। সাধারণত জাহাজ তৈরির শিল্পের সাথে যারা জড়িত তাদের এই ধাতুর সংস্পর্শে আসার সম্ভাবনাটা বেশি থাকে। এই কারণেই অনেক দেশে এই ধাতুর ব্যবহার নিষিদ্ধ। একইভাবে রঙের কারখানা, রাবার বা গ্যাসের কাজে যারা নিয়োজিত তারা এক ধরনের বিশেষ রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শে আসার কারণে মুত্রথলির ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। পরবর্তীতে অনেক দেশে এসব রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহারও নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। পরিবেশগত কারণের অন্যতম একটা হচ্ছে সূর্য। রোদে বেশিক্ষণ থাকার কারণে ত্বকের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তেজস্ক্রিয়তার কারণেও বিভিন্ন ক্যান্সারে আক্রান্ত হোয়ার ঝুঁকি থাকে।

ক্যান্সারের উপসর্গ :
নানা ধরনের ক্যান্সারে নানা ধরনের উপসর্গ দেখা যায়। তবে সাধারণ কিছু উপসর্গ আছে
খুব ক্লান্ত বোধ করা
ক্ষুধা কমে যাওয়া
শরীরের যে কোনজায়গায় চাকা বা দলা দেখা দেয়া
দীর্ঘস্থায়ী কাশি বা গলা ভাঙ্গা
মলত্যাগে পরিবর্তন আসা (ডায়রিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য কিংবা মলের সাথে রক্ত যাওয়া)
জ্বর, রাতে ঠাণ্ডা লাগা বা ঘেমে যাওয়া
অস্বাভাবিকভাবে ওজন কমা
অস্বাভাবিক রক্তপাত হওয়া
ত্বকের পরিবর্তন দেখা যাওয়া

ক্যান্সারের চিকিৎসা : ক্যান্সারের প্রকৃতি অনুসারে নানা রকম চিকিৎসাযর ব্যবস্থা রয়েছে। যেমন-

অস্ত্রোপচার: ক্যান্সার আক্রান্ত স্থানের কোষগুলোকে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে কেটে সরিয়ে ফেলা হয়। ক্যান্সার যদি অল্প একটু জায়গা জুড়ে থাকে এবং প্রাথমিক পর্যায়ে থাকে তাহলে এ ধরনের চিকিৎসা দেয়া হয়।

রেডিওথেরাপি : নিয়ন্ত্রিতভাবে শরীরের অংশবিশেষে তেজস্ক্রিয় রশ্মি প্রয়োগ করে সেই জায়গার কোষগুলোকে ধ্বংস করে ফেলা হয়।

কেমোথেরাপি : এই ব্যবস্থায় ক্যান্সার কোষকে ধ্বংস করতে অ্যান্টি-ক্যান্সার (সাইটোটক্সিক) ড্রাগস বা ওষুধ ব্যবহার করা হয়। ৫০টিরও বেশি এই ধরনের কেমিওথেরাপি ওষুধ রয়েছে। এগুলোর কোনকোনটা ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল হিসেবে খেতে হয়। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই ওষুধগুলোকে স্যালাইনের সাথে বা অন্য কোনভাবে সরাসরি রক্তে দিয়ে দেয়া হয়। রক্তের সাথে মিশে এই ওষুধগুলো শরীরের যেখানে যেখানে ক্যান্সার কোষ রয়েছে সেখানে গিয়ে ক্যান্সার কোষগুলোকে ধ্বংস করার চেষ্টা করে।

হরমোন থেরাপি : শরীরের কিছু হরমোনের মাত্রা পরিবর্তন করার মাধ্যমে এই চিকিৎসা করা হয়। শরীরের বৃদ্ধির সাথে হরমোনের একটা সম্পর্ক রয়েছে। কোন কোন ক্যান্সার এই হরমোনের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়। ফলে ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি কমিয়ে ক্যান্সারকে নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসতে হরমোন থেরাপি ব্যবহৃত হয়।

সহায়ক মানসিক সহায়তা : ক্যান্সারের শারীরিক চিকিৎসার পাশাপাশি রোগীদের মানসিক চিকিৎসার ব্যাপারে এখন জোর দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার পর রোগীরা বেশ মানসিক কষ্টের মধ্যে দিয়ে যান, অনেকে মানসিকভাবে ভেঙ্গেও পরেন। এই কারণে অনেক সময়ে তাদের অবস্থা বেশি গুরুতর না হলেও অনেকে দ্রুত মারা যান। ফলে তাদেরকে বিভিন্ন ধরনের সেবা দেয়ার ব্যবস্থা করার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা এবং উন্নত দেশগুলোতে এ ধরনের সেবা দেয়ার জন্য বিভিন্ন সংগঠন কাজও করে যাচ্ছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ক্যান্সার আক্রান্তদের একটি গ্রুপ গঠন করা, যেখানে তারা নিজেদের অভিজ্ঞতা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করতে পারেন। এর পাশাপাশি যোগ, মেডিটেশন ইত্যাদির মাধ্যমেও রোগীদের মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার শিক্ষা দেয়া হয়। এর পাশাপাশি মানসিক স্বস্তির জন্য কেউ যদি ধর্মীয় বা সামাজিক কোন কাজে নিয়োজিত হতে চান সে ব্যাপারেও তাদেরকে উৎসাহ দেয়া হয়।

অন্যান্য চিকিৎসা: শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে আরো শক্তিশালী করে তোলে এ ধরনের ওষুধ তৈরির ব্যাপারে এখন গবেষণা চলছে। এছাড়াও ক্যান্সারের ভ্যাকসিন তৈরির ব্যাপারে চেষ্টা চলছে। কিন্তু এখনো এগুলো একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।

ক্যান্সার প্রতিরোধক প্রাক্-ব্যবস্থা : নিয়মিত কিছু ব্যাপার মেনে চললে ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেকখানি কমানো যায়। যেমন―
ব্যায়াম : প্রত্যেকদিন নিয়মিত কিছু ব্যায়াম করা
খাদ্যভ্যাস : মাংস খাওয়া বন্ধ করে দেয়া বা কমিয়ে দেয়া। প্রচুর পরিমাণে শাক-সবজি, ফলমূল এবঙ আঁশজাতীয় খাবার খাওয়া। চর্বিজাতীয় পদার্থ কম খাওয়া।
নেশাদ্রব্য : ধূমপান বা মদ্যপান ছেড়ে দেয়া বা পরিমাণ কমিয়ে আনা। পান-সুপারি জর্দা, তামাকপাতা খাওয়া বন্ধ করা।
দেহ সচেতনতা : রৌদ্রে বের হওয়ার সময় সানস্ক্রিন মেখে বের হওয়া। নিয়মিত ডাক্তার দেখানো। সেটা সম্ভব না হলে শরীরে কোন অস্বাভাবিকতা দেখা দিলেই ডাক্তারের কাছে যাওয়া। ৫০ বছরের বেশি বয়স হলে অবশ্যই নিয়মিত ডাক্তারের কাছে গিয়ে শরীর পরীক্ষা করানো।

Pin It on Pinterest

Share This