Select Page
২০২২-১১-০৫
জরায়ুমুখ ক্যান্সার (Cervical cancer।)

নারীদেহের প্রজনন অঙ্গ জরায়ুতে সৃষ্ট ক্যান্সার বিশেষ। সাধারণভাবে একে জরায়ুর ক্যান্সার বলা হয়। এই ক্যান্সার বিশ্বব্যাপী নারীদের অকাল মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। বিশ্বে প্রতি দুই মিনিটে একজন নারী জরায়ুমুখ ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করেন এবং প্রতি বছর ৫০ লক্ষাধিক নারী নতুন করে আক্রান্ত হন।

জরায়ু ক্যান্সারের শিকার
পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০ বছরের কম বয়সীদের এ রোগ ততটা দেখা যায় না। আক্রান্তদের অধিকাংশের বয়স সাধারণত ৩৫ থেকে ৫৫ বছর বয়সের মধ্যে হয়ে থাকে। অনেক সময় ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সী নারী এই রোগে আক্রান্ত হয়। তবে সংখ্যার বিচারে তা তুলনামূলকভাবে কম।

জরায়ু ক্যানসারের কারণ
জরায়ু ক্যান্সারের অন্যতম কারণ হিসেবে ‘হিউম্যান পেপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি) [human papilloma virus (HPV)]

‘ বা ‘ এইচপি ভাইরাস’-কে দায়ি করা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, এই ক্যান্সারের লক্ষণ প্রকাশের প্রায় ২ থেকে ২০ বছর আগেই একজন নারী এই ভাইরাস বা এই জাতীয় দ্বারা আক্রান্ত হন। অপরিচ্ছন্নতা বা ঋতুচক্রের সময় ব্যবহৃত দুষিত কাপড়, যৌন-সংযোগের কারণে এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ১০০ ধরনের এইচপি ভাইরাস সনাক্ত হয়েছে। অবশ্য এর বেশিরভাগই জরায়ু ক্যান্সারের জন্য অতোটা ঝুঁকিপূর্ণ নয়। তবে এইচপিভি-১৬, এইচপিভি ১৮, এইচপিভি-৬, এইচপিভি-১১ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।

স্বাভাবিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত নারীদের জরায়ু প্রায়ই এইচপি ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকে। এতে কোনো উপসর্গ থাকে না বা শারীরিক পরীক্ষায় কোনো চিহ্ন বা ক্ষত পাওয়া যায় না। এর জন্য কোনো চিকিৎসারও প্রয়োজন নেই। শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতাবলে ১৮-২৪ মাসের মধ্যে জরায়ু প্রায় সব এইচপি ভাইরাস থেকে মুক্ত হয়ে যায়। তবে জরায়ুতে এইচপি ভাইরাস দীর্ঘদিন স্থায়ী হলে, জরায়ুমুখের স্বাভাবিক কোষের বৈশিষ্ট্যগত পরিবর্তন ঘটতে থাকেএবং একসময় তা ক্যান্সারে রূপ নেয়।

জরায়ুমুখ ক্যান্সারের উপসর্গ ও তার পরিণতি:
জরায়ুমুখের কোষ, ক্যানসার কোষে পরিণত হলে, তা দ্রুত বাড়তে থাকে এবং এক সময় পিণ্ডে পরিণত হয়। এই পিণ্ড ফেটে গিয়ে জরায়ুমুখে ক্ষত সৃষ্টি করে এবং রক্তক্ষরণ হয়। এই ক্ষত ব্যক্টেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয়ে রোগটিকে আরও জটিল কর৫এ তোলে। এর ফলে শরীরে জ্বর, বেদনা, মাথা ব্যথা, দুর্বলতা ইত্যাদি ,উপসর্গ দেখা দেয়। এক সময় ক্যান্সার কোষগুলো পুরো যৌনাঙ্গকে ধ্বংস করে দেয় এবং যৌনাঙ্গ-সংলগ্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। একসময় এই রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সাধ্যের বাইরে চলে যায় এবং রোগিণীর মৃত্য ঘটে।

জরায়ু ক্যান্সার শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া

পেপস স্মেয়ার টেস্টপেপস স্মেয়ার টেস্ট বা প্যাপ স্মিয়ার টেস্টের দ্বারা এ জাতীয় ক্যান্সার সহজে শনাক্ত করা যায়। এটি একটি ব্যথামুক্ত ও সাশ্রয়ী পরীক্ষা পদ্ধতি। এই পরীক্ষায় প্রথমকে জরায়ুমুখ থেকে রস সংগ্রহ করা হয়। এরপর অণুবীক্ষণযন্ত্র দিয়ে তা পরীক্ষা করে ক্যান্সার, ক্যান্সার হওয়ার পূর্বাবস্থা ও জরায়ুমুখের অন্যান্য রোগ যেমন প্রদাহ (ইনফ্লামেশন) শনাক্ত করা যায়। সাধারণত বিবাহিত নারীদের ২১ বছরের পর থেকে এ পরীক্ষা শুরু করা যেতে পারে এবং দুই বছর অন্তর একবার করে পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দেয়া হয়। ৩০ থেকে ৬৪ বছর বয়সের ভিতরে, এই পরীক্ষার ফলাফল তিনবার ‘স্বাভাবিক’ আসলে― তারপর থেকে প্রতি তিন বছর পর পর এই পরীক্ষা করা উচিত। তবে চিকিৎসকের পরামর্শে এই পরীক্ষার সময়সূচি পরিবর্তন হতে পারে।

প্রতিরোধক ব্যবস্থা
সাধারণত ১০ বছর বয়সের পর থেকেই জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধক টিকা নেয়া যায়। মোট তিন ডোজ টিকা নিতে হয়; প্রথম ডোজের এক মাস পর দ্বিতীয় ডোজ এবং প্রথম ডোজের ছয় মাস পর তৃতীয় ডোজ টিকা নিতে হয়। টিকা গ্রহণের পাশাপাশি নিয়মিত পরীক্ষা করালে জরায়ুমুখ ক্যান্সারের আক্রমণ হার কমিয়ে আনা যায়। ভাইরাস এইচপিভি-১৬, এইচপিভি-১৮, এইচপিভি-৬, এইচপিভি-১১-এর প্রতিরোধক টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে। গর্ভাবস্থায় এ টিকা প্রদানের অনুমোদন নেই। উল্লেখ্য আক্রান্ত হয়ে ক্যান্সার সংঘটনের পর এই টিকা আর কোনো কাজে আসে না।

আচরণগত প্রতিরোধক ব্যবস্থা
চিকিৎসার চেয়ে আচরণগত প্রতিরোধক দিকে বিজ্ঞানীরা বেশি গুরুত্বারোপ করেছেন। এই আচরণগত প্রতোরোধক ব্যবস্থাগুলো হলো―

বাল্য-বিবাহ রোধ
অধিক সন্তান প্রসব
ধূমপান করা (এমনকি পরোক্ষ ধূমপানের স্বীকার হওয়া)]
পানের সাথে জর্দা, সাদা পাতা, দাঁতের গোড়ায় গুল (তামাকের গুঁড়া) রাখা ইত্যাদি কারণে এই ক্যান্সারে আক্রান্তের সম্ভাবনা বাড়ে।
আর সুষম খাবার গ্রহণ
দৈনিক তিন-চারবার ফল, শাকসব্জি, তরকারি খাওয়া
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, স্বাস্থ্যসম্মত, সুশৃঙ্খল জীবনযাপন ও সামাজিক অনুশাসন মান্য করা এই রোগ প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
এর পাশাপাশি নারীর, নিয়মিত পেপস স্মেয়ার টেস্টে অংশ নেওয়া উচিত, তাতে রোগ আগেভাগে সনাক্ত করা সম্ভব হয়।

জরায়ুমুখ ক্যান্সার বিশ্বব্যাপী ১২তম সবচেয়ে পরিচিত রোগের নাম। নারীদের জন্য ৫ম প্রাণঘাতী রোগের নাম জরায়ুমুখ ক্যান্সার। প্রতিলাখে প্রতিবছর ১৬ জন নারী এই রোগে আক্রান্ত হন। যাদের ৮জনই মৃত্যুবরন করেন। আনুমানিক ৮০শতাংশ উন্নয়নশীল দেশের নারীরা এই ব্যাধিতে আক্রান্ত। ২০০৮ সালে বিশ্বব্যাপী ৪৭৩,০০০ টি জরায়ুমুখ ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার ঘটনা জানা যায়। ২৫৩,০০০ জনের প্রতিবছরে মৃত্যু হয়। বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ১৩,০০০ নারী নতুন করে জরায়ুমুখ ক্যান্সারে আক্রান্ত হন এবং প্রতিবছর মৃত্যুবরণ করেন প্রায় ৬,৬০০ নারী (প্রেক্ষিত ২০১০)। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে সারাদেশে ১৮ জন নারী মারা যাচ্ছেন জরায়ু-মুখ ক্যান্সারে। জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ক্যান্সার ইপিডেমিওলজি বিভাগ থেকে প্রকাশিত প্রতিবেদন মতে― ২০০৫ সালে পাঁচ হাজার ৪১১ জন মোট ক্যান্সার শনাক্ত রোগীর মধ্যে, নারীর সংখ্যা ছিল ২২৭৫ জন। এর মধ্যে জরায়ুমুখের ক্যান্সারের রোগীর সংখ্যা ছিল ৫৬১ জন।এ ক্যান্সারে আক্রান্ত ৫৬১ জনের মধ্যে ২১৩ জনেরই বয়স ছিল ৪০ থেকে ৪৯ বছর বয়সের মধ্যে। আর ২০ থেকে ২৯ বছর বয়সের মধ্যে ছিল ২৬ জন।

সূত্র :
জরায়ুমুখের ক্যানসার ও এই রোগের প্রতিরোধ, পারভীন শাহিদা আখতার (অধ্যাপক, জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট), দৈনিক প্রথম আলো, প্রকাশ: ২ ফেব্রুয়ারি ২০১১; পরিদর্শনের তারিখ: ২৭ অক্টোবর ২০১১ খ্রিস্টাব্দ।

Pin It on Pinterest

Share This