প্রতি বছর ৮ই মার্চ ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ উদযাপিত হয়। এই দিনটিকে আমরা ঐতিহাসিকভাবে যুক্ত করে থাকি বিশ্বব্যাপী নারী অধিকার আন্দোলনের বিভিন্ন সংগ্রামী অধ্যায়ের সাথে। ১৮৫৭ সালের ৮ই মার্চ তারিখে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরের সেলাই কারখানার নারী শ্রমিকরা বিপদজনক ও অমানবিক কর্মপরিবেশ, স্বল্প মজুরী এবং দৈনিক ১২ ঘন্টা শ্রমের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ মিছিল বের করেন। তাঁদের এই শান্তিপূর্ণ মিছিলের উপর পুলিশ হামলা চালায়। তিন বছর পরে ১৮৬০ সালের ৮ই মার্চে নিউ ইয়র্ক শহরের গার্মেন্টস কারখানার নারী শ্রমিকরা সংঘবদ্ধ হয়ে তাদের দাবী আদায়ের লক্ষ্যে নিজস্ব ইউনিয়ন গঠনে সমর্থ হন। এরপর ১৯০৮ সালের ৮ই মার্চ আবারও নিউ ইয়র্ক শহরে একটি প্রতিবাদ মিছিল বের হয়, যেটিতে বস্ত্রশিল্প কারখানার নারী শ্রমিকরা যোগ দেন। ৮ই মার্চ তারিখে এই ঘটনা ধারার সম্মিলনের ফলেই ১৯১০ সালে জার্মান সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী ক্লারা জেটকিনের প্রস্তাব অনুসারে ঐ দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ ঘোষণা করা হয়।
এ বছর ‘আন্তর্জাতিক নারীদিবস কমিটি’র আয়োজনে আমরা ৫০টি সংগঠন, জোট, নেটওয়ার্ক এবং ফোরাম একত্রিত হয়ে অবদমনের প্রতিবাদে গণতন্ত্রের দাবি নিয়ে আগামী ২৭ ফাল্গুন ১৪২৭/১২ মার্চ ২০২১, শুক্রবার ঢাকায় পদযাত্রায় বের হবো। তাছাড়া সারা দেশে আরো ১০০টি স্থানে একই প্রতিপাদ্য নিয়ে দিবসটি পালন করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের সংবিধান মানুষের অধিকারের নিশ্চয়তার কথা বলে। এ অধিকার বাকস্বাধীনতার অধিকার, চলাফেরার অধিকার, সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার, সংগঠিত হওয়ার অধিকার এবং সর্বোপরি সরকার, পরিবার ও সমাজের কর্তাব্যক্তিদেরকে প্রশ্ন করার অধিকার। এই অধিকারগুলো নারীবাদী লড়াইয়ের মূলমন্ত্র। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছাড়া নারী এবং প্রান্তিক অবস্থানে বিভিন্ন লৈঙ্গিক পরিচয়ের মানুষের পক্ষে ক্ষমতাকে প্রশ্ন করা, জবাবদিহিতায় বাধ্য করা এবং ন্যায় বিচার আদায় করা অসম্ভব।
আমাদের প্রতিবাদের অন্যতম বিষয় বাকস্বাধীনতা এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এই আইন যে অগণতান্ত্রিক এবং সকলের নিরাপত্তার হুমকিস্বরূপ তার উদাহরণ আমরা দেখেছি গত বছর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে, যেখানে যৌন নিপীড়নের শিকার একজন নারীকে ভয় দেখাতে তার উপর সংঘবদ্ধ আক্রমণ ও নিপীড়নের ভিডিও ছড়িয়ে দিয়েছিলো আক্রমণকারীরা। পরবর্তীতে জানা গেছে যে, আক্রমণকারীরা রাজনৈতিক ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত কিছু পুরুষ।
আমরা জানি, এই অবদমনমূলক পরিস্থিতির বিস্তার ক্রমশ আমাদের কণ্ঠ রোধ করবে; সঙ্কুচিত করে আনবে আমাদের প্রশ্ন করার জায়গাকে, কারণ বিদ্যমান যৌনসহিংসতার সংস্কৃতি লিঙ্গ সম্পর্কিত প্রাচীন ধারণার উপর ভর করে মানুষের আচরণকে বিচার করে, নারীবিদ্বেষী আচরণকে উৎসাহিত করে এবং কঠোর বিধিনিষেধের নিগড়ে বন্দি করে নারীর গতিবিধি ও ইচ্ছার স্বাধীনতাকে।
আমাদের লড়াই মুক্তির জন্য, গণতন্ত্রের জন্য। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে আমাদের অতীতের সকল সাফল্য ও অর্জন ধরে রাখতে এবং ভবিষ্যতের অগ্রযাত্রার পথ সুগম করতে প্রয়োজন যথাযথ গণতন্ত্র। এর জন্য আমাদের এই লড়াই অবধারিত।
আমাদের কাছে গণতন্ত্র মানে,
* সব মানুষের অস্তিত্ব, পরিচিতি ও অধিকারের স্বীকৃতি অর্থাৎ শ্রেণি, ভাষা, জাতি, লিঙ্গ, যৌন পরিচিতি, ধর্ম, সক্ষমতা, বয়স ইত্যাদি নির্বিশেষে সকলের সম-মর্যাদা ও সম অধিকার নিশ্চিত করণ
* বিচার ব্যবস্থায় সকলের অভিগম্যতা
* ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর শাসন নয়, আইনের শাসন
* সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতার বিধান সমুন্নত রাখা এবং সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সরকারি বিবেচনা ও আচরণে এর দৃশ্যমান প্রতিফলন থাকা
* সর্বোপরি একটি মানবিক রাষ্ট্র, যেখানে গণ-মানুষের কল্যাণ হবে সরকারের সকল উদ্যোগের কেন্দ্রবিন্দু এবং বিচারিক ও বিচার বহির্ভুত হত্যা বন্ধ, রাষ্ট্রীয় বাহিনী দ্বারা গুম ও অপহরণ বন্ধ।
তাই, রাষ্ট্রের কাছে আমাদের দাবি:
১. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ সকল নিপীড়নমূলক আইন বাতিল।
২. নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আইনগুলোকে জাতিসংঘের ‘নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ’ সনদের আলোকে সংশোধন করা, যেমন- ধর্ম, জাতি, গোষ্ঠি, লিঙ্গ নির্বিশেষে সকল সন্তানের জন্য সমান উত্তরাধিকার।
৩. গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে রাষ্ট্রের উদ্যোগ চাই। ভিন্ন মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং ভিন্নমত মেনে নেয়ার মানসিকতা- উভয়ই গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য। গণতন্ত্র কেবল শাসন ব্যবস্থায় নয়, সর্বত্র গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রসার ঘটাতে হবে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে।
৪. প্রশাসনের জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ এবং দুর্নীতি হ্রাসে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ।
৫. নারীদের শিক্ষা ও কর্মসংস্থানকে প্রাধান্য দিয়ে পরিবারে পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যর অবসান।
৬. শাসনব্যবস্থায় নারী ও প্রান্তিক সকল জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের পথ সুগম করতে সরকারের বিকেন্দ্রীকরণ।
৭. সংবিধানে জনজীবন ও পারিবারিক জীবন উভয় ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতা নিশ্চিত করণে ধর্মভিত্তিক পারিবারিক আইনের বিলুপ্তি।
৮. পাঠ্যপুস্তকে নারীর বিভিন্ন ভূমিকার ইতিবাচক উপস্থাপন।
৯. পথেঘাটে, গণ-পরিবহনে নারীকে উত্ত্যক্তকরণ বন্ধে জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ এবং কর্মক্ষেত্রে সকলপ্রকার যৌন হয়রানি নিরসনে আইএলও কনভেনশন ১৯০এ অনুস্বাক্ষর দান।
১০. ধর্ষণ ও নারীনির্যাতন মামলার বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা হ্রাসে বিচারক ও ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বৃদ্ধি।
আমাদের করনীয়:
১. রাষ্ট্রের কাছে উপরোক্ত সকল দাবীর পক্ষে জনমত গঠন
২. মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকারের মূলনীতি “বেঁচে থাকার অধিকার”- এর সাথে মৃত্যুদন্ড সাংঘর্ষিক; তাই যেকোনো অপরাধের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ড বাতিল করার জন্য জনমত গঠন
৩. নারীনেতৃত্ব নির্মাণ ও এর বিস্তৃতিকরণ
৪. স্থানীয় থেকে জাতীয় পর্যায়ের সকল স্তরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর কার্যকর ও সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ
৫. শাসন ব্যবস্থাকে দলীয় ও আত্মীয়করণ, অপশক্তি, পক্ষপাত্তিত্ব, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে নাগরিক সমাজকে সাথে নিয়ে একযোগে চাপ সৃষ্টি করণ।
কর্মসূচি
পদযাত্রা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান
দিনক্ষণ: ২৭ ফাল্গুন ১৪২৭/১২ মার্চ ২০২১, শুক্রবার, সকাল ৯টা – দুপুর ১২টা। নূর হোসেন চত্ত্বরে জমায়েত হয়ে পদযাত্রা করে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে গিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।