যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ
১৯৬০ সালের ২৫ নভেম্বর ডোমিনিক্যান রিপাবলিকের স্বৈরাচারী সরকার বিরোধী মিরাবেল ভগিনীত্রয়কে সেনা সদস্যরা ধর্ষণ ও হত্যা করে। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য ১৯৮১ সালে ল্যাটিন আমেরিকান ও ক্যারিবিয় নারী সম্মেলন এই হত্যাকান্ডকে স্মরণ করে ২৫ নভেম্বরকে ‘নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ দিবস’ ঘোষণা করে। ১৯৯১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর উইমেনস্ গ্লোবাল লিডারশীপের এক প্রশিক্ষণে ২৩টি দেশ থেকে আগত অংশগ্রহণকারীগণ নারী নির্যাতন মানবাধিকার লঙ্ঘন- এই চিন্তার ভিত্তিতে ২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার দিবস পর্যন্ত পক্ষকাল ব্যাপী নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে কর্মসূচি গ্রহণের প্রস্তাব করেন। এই ডাকে সাড়া দিয়ে এযাবৎ ১৮৭টি দেশে ছয় হাজারের বেশী সংগঠন ১৬ দিনব্যাপী নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিশ্ব অভিযানে অংশগ্রহণ করে আসছে। বাংলাদেশে ‘নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ দিবস উদ্যাপন কমিটি’ ১৯৯৭ সাল থেকে একেক বছর একেকটি নির্দিষ্ট প্রতিপাদ্য নিয়ে দিবসটি পালন করছে। এবারের প্রতিপাদ্য “যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ”। যৌন নিপীড়ন মোকাবেলায় প্রতিরোধ গড়ে তোলার গুরুত্বের প্রতি সবার মনোযোগ আকর্ষণ করতে এবং তৎপরতা বৃদ্ধি করতে এই প্রতিপাদ্য নির্বাচন করা হয়েছে।
নারী নির্যাতনের চরম সহিংস রূপ হচ্ছে ধর্ষণ ও ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা। আমরা ধর্ষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন বহাল রেখেছি এবং ধর্ষণ আইন সংস্কার জোটের দশ দফা দাবির ব্যাপারে অনড়। সম্প্রতি সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারার বিলুপ্তি চেয়ে আদালতে রীট আবেদন করা হয়েছে। এই ধারার বিলুপ্তির মধ্য দিয়ে ধর্ষণের অভিযোগকারী নারীর চরিত্র নিয়ে আদালতে তাকে আর হেনস্তা করা যাবে না।
যৌন নিপীড়ন প্রায় প্রতিটি নারীর প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতা। লিঙ্গান্তরিত ও হিজড়া নারীর ক্ষেত্রেও এই অভিজ্ঞতা ভিন্ন নয়। ঘরে, বাইরে, রাস্তায়, যানবাহনে, কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, চলতে-ফিরতে শরীরের উপর অযাচিত স্পর্শ, চাহনি, অঙ্গভঙ্গি ও বাজে মন্তব্যসহ নানাভাবে যৌন হেনস্তার শিকার হয় নারী, যা তাকে সর্বদা ভীতসন্ত্রস্ত ও সঙ্কুচিত করে রাখে। ফলে তার স্বাভাবিক বিকাশ হয় বাধাগ্রস্ত, কখনো কখনো জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিসহ।
নারীর উপর যৌন নিপীড়ন কেবলমাত্র কোন ব্যক্তির একক বা বিচ্ছিন্ন কোন আচরণ নয়। এর মূলে রয়েছে নারীকে অধস্তন ও পুরুষের ভোগ্যবস্তু বিবেচনা করা এবং সর্বোপরি তাকে মানুষ হিসেবে গণ্য না করা। এই চিন্তা-চেতনা, দৃষ্টিভঙ্গি, নিয়ম ও আইন-কানুন এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি নারীর উপর যৌন নিপীড়নকে উৎসাহিত করে। এর প্রতিকার ও প্রতিরোধ হওয়া জরুরী, তাই এ আচরণ যে বা যারাই করুক, যেখান থেকেই আসুক, এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বহাল রাখতে হবে, ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। নারী বিরুদ্ধ সংস্কৃতি ও অসহিষ্ণু এবং বৈষম্যমূলক সমাজচিন্তা পরিবর্তনের জন্য প্রত্যেককে নিজ নিজ অবস্থান থেকে একক ও সম্মিলিতভাবে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে কাজ করে যেতে হবে।
আমাদের করণীয়:
* নারীর উপর যৌন নিপীড়নকে অপেক্ষাকৃত কম ভয়াবহ মনে করে একে উপেক্ষা না করা, এর বিরুদ্ধে অনমনীয় ও জোরালো সামাজিক অবস্থান নির্মাণ করা
* যৌন নিপীড়নের শিকার নারীকে সকল প্রয়োজনীয় সেবা পেতে সাহায্য করা এবং ঘটনা আড়াল বা গোপন না রেখে প্রকাশ করতে সাহস দেয়া
* নারীর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে উদ্যোগ গ্রহণ
* যৌন নিপীড়নের শিকার নারীকে দোষারোপ করা মাত্রই প্রতিবাদ করা
* নারীকে ভোগ্যবস্তু নয়, মর্যাদাসম্পন্ন মানুষ ভাবতে এবং ভাবাতে হবে।
জাতীয় সংসদের কাছে দাবি:
* নারীর উপর যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ ও প্রতিকার করতে প্রচলিত আইনের সংস্কার ও যুগোপযোগী আইন দ্রুত প্রণয়ন করুন
* প্রচলিত আইনে যৌন নিপীড়নের শিকার নারীর প্রতি অসম্মানজনক ও বৈষম্যমূলক বিধানসমূহ এবং শব্দ-বাক্য অনতিবিলম্বে বাতিল করুন।
সরকারের কাছে দাবি:
* নারীর উপর সহিংসতা, যৌন নিপীড়ন ও ধর্ষণ সংক্রান্ত সকল আইন বাস্তবায়নের অগ্রগতি নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও প্রতিবন্ধকতাসমূহ দূর করতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করুন
* যৌন নিপীড়ন ঘটনার তদন্তের সাথে সম্পৃক্ত পুলিশ, চিকিৎসক-নার্সসহ সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করুন
* থানা, হাসপাতাল ও আদালতকে নারীর প্রতি মর্যাদাসম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গী ও আচরণ তৈরির লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ প্রদানসহ সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করুন
* পাঠ্যসূচিতে নারীর প্রতি অসম্মানজনক ও বৈষম্যমূলক বিষয় এবং ভাষা ও শব্দ বাতিল করুন
* কর্মক্ষেত্রে যৌন সহিংসতা ও নিপীড়ন নিরসন সংক্রান্ত আইএলও কনভেনশন ১৯০ অনুস্বাক্ষর এবং প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করুন।
যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধে আমাদের সম্মিলিতভাবে লড়াই করতে হবে, ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এই আন্দোলনে আপনি নিজে যোগ দিন এবং অন্যকে যুক্ত করুন।
নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ দিবস উদ্যাপন কমিটি
প্রকাশকাল: ১০ অগ্রহায়ণ ১৪২৮/২৫ নভেম্বর ২০২১