Select Page
২০১৬-১১-২৫
নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ দিবস-২০১৬

নারীর উপর সহিংসতা নিরসনে আইন-আদালতের ভূমিকা

নারীর উপর নির্যাতন, সহিংসতা, অপমান, অবহেলা নতুন কোন বিষয় নয়। যুগ যুগ ধরে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে জীবনের কখনো না কখনো প্রায় প্রতিটি নারীকেই এই অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়; যার অন্তর্নিহিত কারণ পরিবারে, সমাজে ও রাষ্ট্রে নারীর অধস্তন অবস্থান, নারীকে মানুষ হিসাবে গণ্য না করার মানসিকতা, দৃষ্টিভঙ্গী ও সংস্কৃতি এবং সর্বোপরি নারীকে ভোগ্যবস্তÍু ভাবা। এর সাথে যুক্ত হয়েছে দেশে বিরাজমান গণতন্ত্রহীনতা, দলীয় রাজনীতির আগ্রাসন ও ক্ষমতার নির্লজ্জ প্রতিযোগিতা; যার ফলশ্রæতি বিচারহীনতা, প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ও অনিয়ম। এহেন অবস্থা নারীর উপর নির্যাতন এবং সহিংসতার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। আমাদের সংস্কৃতিতে নারীকে বিভিন্নভাবে হেয় করা হয়, নারীর চরিত্রের উপর আক্রমণকে অন্যায় বা অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না, নারীর শরীর ও যৌনতার উপর আঘাতের প্রতিবাদ করার পরিবর্তে নারীকে দোষারোপ ও নিন্দার প্রবণতাই বেশী। এই পরিস্থিতিতে নারীর উপর সহিংসতা রোধে আইনের ভূমিকা কতটুকু ? নারীর উপর ঘটে যাওয়া সহিংসতা যখন আর ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে চাপা থাকে না এবং বিশেষত শারীরিক আঘাত যখন গুরুতর হয় কেবলমাত্র তখনই আইন-আদালতের ভূমিকার কথা আসে।

নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য ১৯৮১ সালে ল্যাটিন আমেরিকা মহাদেশের নারীদের সম্মেলনে ২৫ নভেম্বরকে ‘নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ দিবস’ ঘোষণা করা হয়। ১৯৯৩ সালে ভিয়েনায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব মানবাধিকার সম্মেলনে এ দিবসটি স্বীকৃতি পায় এবং তখন থেকে বিভিন্ন দেশে দিবসটি পালন করা হয়। নারীপক্ষ ১৯৯৭ সাল থেকে প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে দিবসটি পালন করে আসছে ১। এবারের প্রতিপাদ্য “নারীর উপর সহিংসতা নিরসনে আইন-আদালতের ভূমিকা।”

দেশে একের পর এক নারী ধর্ষণ, হত্যা ও নানাবিধ নির্যাতনের ঘটনায় সারাদেশ উৎকণ্ঠিত। বহুমাত্রিক প্রচেষ্টার মাধ্যমেই নারীর উপর সহিংসতা রোধ ও প্রতিকার সম্ভব, এর মধ্যে আইন একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। বাংলাদেশে সহিংসতার শিকার নারীর বিচার প্রাপ্তির জন্য বিশেষ আইন – ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন, ২০০৩’ রয়েছে। এই আইনের অধীনে মামলা পরিচালনার সার্বিক দায়দায়িত্ব সরকারের। আইনটি প্রয়োগের জন্য বিশেষ তদন্ত ব্যবস্থাসহ প্রতিটি জেলায় পৃথক আদালত আছে, আছেন বিশেষ আইনজীবী।

নারীপক্ষ ১৯৯৮ সাল থেকে পুলিশ, স্বাস্থ্য ও বিচার বিভাগের সাথে যুক্ত হয়ে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন ২০০৩’ প্রয়োগের কাঠামোগত ও পদ্ধতিগত সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করার উদ্যোগ নেয়। এরই ধারাবাহিকতায় নারীপক্ষ ২০১১-২০১৫ সাল পর্যন্ত ঢাকা, জামালপুর, ঝিনাইদহ, সিরাজগঞ্জ, জয়পুরহাট ও নোয়াখালীসহ মোট ৬টি জেলায় ৭টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে ১১,৮৬৪টি মামলা পর্যবেক্ষণ করে। এর মধ্যে ৩,৫৮৮টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। নিষ্পত্তিকৃত মামলার মধ্যে সাজা হয়েছে ১৮টিতে, খালাস হয়েছে ১,০৪৭টিতে, অব্যাহতি পেয়েছে ২,৫২৩টিতে এবং ৮,২৭৬টি মামলা বিচারাধীন আছে ২।

এছাড়া, নারীপক্ষ এই আইনের আওতায় দায়েরকৃত ২৯টি ধর্ষণ, ২৫টি যৌতুক, ২টি অপহরণ, ১টি এসিড আক্রমণ, ৩টি দাহ্য পদার্থ দ্বারা আঘাতসহ মোট ৬০টি মামলা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে। ২৭ জন সহিংসতার শিকার নারী ও ৯ জন অভিযুক্ত ব্যক্তির সাথে নিবিড় সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে মামলা দায়ের থেকে বিচারকার্য পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায় সম্পর্কে মতামত গ্রহণ করা হয়। এ থেকে জানা যায়,
* ভুক্তভোগী কেউই স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারছে না। তারা ভীত সন্ত্রস্ত। ঘুমাতে পারে না, লজ্জায় ঘরের বাইরে যেতে পারে না, অন্যদের সাথে মিশতে পারে না
* নির্যাতনের শিকার নারীকে তার পরিবার বোঝা মনে করে
* থানা, হাসপাতাল ও আদালতে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের শিকার নারীর প্রতি সম্মানজনক আচরণ করে না; ঘটনার জন্য তাকেই দায়ী করে নানা ধরনের মন্তব্য করে, যেমন: থানায় মামলা করতে গেলে- “মেয়েরা আসলেই খারাপ। একটা ছেলে দৈহিক মেলামেশা করতে চাইতেই পারে কিন্তুু মেয়েরা সহজেই মেলামেশায় লিপ্ত হয় এবং পরে বিয়ে করতে না চাইলে ধর্ষণের মামলা করে।” হাসপাতালে মেডিকোলিগ্যাল পরীক্ষার সময়ে- “বেহায়া মেয়ে, আগেই শরীর পাইতা দেয়, …”, ইত্যাদি। আদালতে সাক্ষ্য গ্রহণকালে আসামীর আইনজীবী সহিংসতার শিকার নারীকে ‘খারাপ মেয়ে’ বা ‘দেহব্যবসায়ী’ হিসেবে প্রমাণ করতে সচেষ্ট থাকে
* সহিংসতার শিকার নারীর পক্ষে মামলা চালনার জন্য সরকার কর্তৃক নিয়োজিত আইনজীবী (পিপি) থাকলেও সহিংসতার শিকার নারীকে প্রতি হাজিরাতেই পিপিকে টাকা দিতে হয়েছে
* মামলার দীর্ঘসূত্রিতার জন্য সহিংসতার শিকার নারী ও তার পরিবার মানসিক এবং আর্থিক শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। উল্লেখ্য, এই মামলাগুলোতে পুলিশ কর্তৃক চার্জশীট প্রদান থেকে আদালতে চার্জ গঠনে সময় লেগেছে এক থেকে দশ মাস
* ৬০টি মামলার মধ্যে ধর্ষণ ৭টি ও যৌতুক সংক্রান্ত ৬টিসহ মোট ১৩টি মামলায় আপোষ হয়েছে।

নারীর উপর সহিংসতা বা যেকোন ধরনের নির্যাতন গুরুতর অপরাধ। আমরা এই প্রতিটি অপরাধের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত এবং মান সম্পন্ন বিচার দেখতে চাই। তবে কোন ঘটনার বীভৎসতা যেন আমাদের মানবিক মূল্যবোধকে নিঃশেষ করে না দেয় সে বিষয়েও সজাগ থাকতে হবে। সরকারকে মামলার সাথে সম্পৃক্ত পুলিশ, চিকিৎসক, আইনজীবী ও অন্যান্য সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং বিচার ব্যবস্থাকে জনগণের আস্থা ও আশ্রয়ের স্থলে উন্নীত করা।

নারীর উপর সহিংসতা নিরসনের জন্য আমাদের প্রত্যেককে নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রতিবাদ করতে হবে, প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে; বিশেষ করে যে সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন ২০০৩’ প্রয়োগের সাথে সম্পৃক্ত বা যুক্ত সেই সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে অনেক বেশী দায়িত্বশীল, আন্তরিক ও তৎপর হতে হবে এবং সহিংসতার শিকার নারীর প্রতি সংবেদনশীল হতে হবে।

ঘরে, বাইরে, থানায়, হাসপাতালে, আদালতে – সর্বত্র নারীকে মানুষ ভাবুন, মানুষ হিসেব চিনুন এবং তার প্রতি সন্মানজনক আচরণ করুন। নারীকে দোষারোপ না করে তার প্রতি সহমর্মী হোন, পাশে দাঁড়ান।

Pin It on Pinterest

Share This