ভূমিকা
দুর্বলতা, ক্ষয়রোগ বা ধাতুভাঙ্গা বলে পরিচিত অসুস্থতা আসলে আর কিছু নয়, এটি হচ্ছে মেয়েদের সাদাস্রাব জনিত সমস্যা। সাদাস্রাব নারীর শরীরের একটি স্বাভাবিক নিঃসরণ। তবে সব সাদাস্রাবই স্বাভাবিক নয়। সাদাস্রাব বিষয়ক নারীপক্ষ’র একটি সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে দেখা যায় যে, ৫৪৯ জন নারীর মধ্যে ২২%-এর ক্ষেত্রে এই নিঃসরণ এতটাই অস্বাভাবিক যে তাদের আলাদা কাপড়, প্যাড বা প্যান্টি ব্যবহার করতে হয়েছে। ৫০.৩%-এর ক্ষেত্রে এর রং ও ঘনত্বের পরিবর্তন ছিল লক্ষণীয় এবং ৫৩.৭% বলেছে সাদাস্রাবের সমস্যার সাথে চুলকানীও ছিল। উল্লেখ্য যে, ২০০৭ সালে বরিশাল বিভাগের পাঁচটি জেলায় (বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী ও বরগুনা) অবস্থিত বিভিন্ন গ্রামের ১০-৭০ বছর বয়সের ৫৪৯ জন নারীর ওপর সমীক্ষাটি করা হয়। তাদের মধ্যে ৭৯% বিবাহিত এবং ৬৯% অন্তত এক সন্তানের মা। তাদের কেউ কেউ ২৫ বছর ধরে অস্বাভাবিক সাদাস্রাব জনিত সমস্যায় ভুগছেন। ২০০১-২০০৩ সালে ঢাকা শহরের একটি বস্তিতে ১৫-১৯ বছর বয়সের ১৫৩ জন বিবাহিত মেয়ের ওপর ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত অপর একটি সমীক্ষায় দেখা যায় যে ৫৭.৫১% মেয়েরাই অস্বাভাবিক সাদাস্রাব জনিত সমস্যায় ভুগছেন।
সাদাস্রাবের অস্বাভাবিকতা শারীরিক, মানসিক, বৈবাহিক ও সামাজিক জটিলতা তৈরি করে থাকে। অথচ সাদাস্রাবের স্বাভাবিকতা বজায় রাখা তেমন কোন কঠিন ব্যাপার নয়। বিষয়টি সম্পর্কে জানলে ও নিজের ব্যাপারে একটু সচেতন হলে এই শারীরিক সমস্যা থেকে অনেকাংশেই মেয়েরা নিজেদের রক্ষা করতে পারে। ইতিমধ্যে যারা এই সমস্যায় ভুগছেন ও আগামীতে এই সমস্যায় কেউ যেন না ভোগে এবং সুস্থ স্বাভাবিক ও উন্নত জীবনযাপন করতে পারে সেই জন্যই আমাদের এই প্রচারপত্র।
সাদাস্রাব কি?
পানির মতো তরল পিচ্ছিল স্বচ্ছ সাদা পদার্থ যা মেয়েদের যোনিপথ দিয়ে বের হয়ে আসে। এটা জরায়ু ও যোনিপথের সাধারণ নিঃসরণ যাতে মরা কোষ ও কিছু ব্যাকটেরিয়া থাকে। এটি এক ধরনের অম্ল (অপরফরপ) নিঃসরণ।
স্বাভাবিক সাদাস্রাব
যে কোনো সুস্থ্য নারীর শরীর থেকে এ ধরনের নিঃসরণ খুবই স্বাভাবিক এবং প্রয়োজনীয়। যোনিপথ নারীদেহের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ কারণ, (১) এটি একটি যৌন অঙ্গ, সহবাসে এটি সরাসরি ব্যবহৃত হয়। (২) এটি একটি প্রজনন অঙ্গ, এই পথে বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হয়। (৩) এই নলাকার অঙ্গের মাধ্যমে পেটগহবরের সাথে বাইরের সরাসরি যোগাযোগ আছে, তাই যোনিপথের সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি এবং তা পেটগহবরে ছড়িয়ে গিয়ে জীবনের মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। স্বাভাবিক সাদাস্রাব এই অঙ্গের সুস্থতা বজায় রাখতে, একে কর্মক্ষম রাখতে ও পেটগহবরের সংক্রমণ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সাদাস্রাবের পরিমাণ নারীর জীবনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম হতে পারে। বিশেষ কিছু সময়ে যেমন, যৌন ভাবনা বা উত্তেজনার সময়, ডিম্ব প্রস্ফুটনের সময় (ঋতুচক্রের মাঝামাঝি সময়), মাসিকের আগে ও পরে, গর্ভকালীন সময় ও সদ্য ভূমিষ্ঠ মেয়ে শিশুর ক্ষেত্রে একটু বেশি নিঃসরণ এতটাই স্বাভাবিক যে এটা আপনার যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যের সুস্থতাকেই ইঙ্গিত করে। তবে এই নিঃসরণের স্বাভাবিক মান বজায় রাখা জরুরি, নতুবা তা অস্বাভাবিক সাদাস্রাবে রূপান্তরিত হতে পারে।
অস্বাভাবিক সাদাস্রাব
যে স্রাব নিঃসরণে অস্বসিত্ম বোধ হয় যেমন;
১. বেশি পরিমাণ নিঃসরণ যাতে পরনের কাপড়, পেটিকোট, পাজামা বা প্যান্টি বেশি ভিজে যায়।
২. নিঃসরণের সাথে যোনিপথ ও আশেপাশের অংশ চুলকায়।
৩. নিঃসরণের সাথে দুর্গন্ধ বের হয়।
৪. নিঃসরণ স্বচ্ছ সাদা, তরল ও পিচ্ছিলের পরিবর্তে বাদামী, সবুজ, হলুদ বা ঘন সাদা থকথকে হয়।
৫. ফেনাসাদা বা চাল ধোয়া পানির মতো তরল পদার্থ বের হয়।
অস্বাভাবিক সাদাস্রাব শরীর থেকে অতিরিক্ত পানি ও আমিষ বের করে দেয়। এ সময়ে পুষ্টি, বিশ্রাম ও সচেতনতার অভাবে শরীর ধীরে ধীরে দুর্বল হয় এবং এক সময় ক্ষয় হতে শুরু করে। এ ধরনের উপসর্গ শুধু অস্বস্তি তৈরি করে না বরং বিভিন্ন রোগেরও উপসর্গ; বিশেষ করে জীবাণু সংক্রমণ (ওহভবপঃরড়হ)। এই সংক্রমণের ক্ষেত্রে অনিরাপদ যৌন সম্পর্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসাবে বিবেচ্য। তাই এ বিষয়ে সব মেয়ের এমনকি ছেলেদেরও জানা দরকার, তাহলে আমরা প্রতিকারের ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হব।
সাধারণ কিছু সংক্রমণের ধরন নিয়ে নিচে আলোচনা করা হল:
নং | সংক্রমণের নাম | সাদাস্রাবের ধরন | সংক্রমিত ব্যক্তির সাথে যৌনসম্পর্কের মাধ্যমে এ রোগ হয় কিনা? |
১. | ইস্ট (ফাঙ্গাস) | ঘন, সাদা দেখতে পনিরের মতো | না |
২. | ট্রাইকোমোনিয়াসিস সবুজ, | হলুদ অথবা ঘিয়ে রঙের ফেনাযুক্ত | হ্যাঁ |
৩. | ব্যাক্টেরিয়া সংক্রমণ | মাছের গন্ধযুক্ত সাদাস্রাব | না |
৪. | গনোরিয়া ধোয়াটে, | হলুদ কখনও কখনও কোনো উপসর্গই থাকে না | হ্যাঁ |
৫. | ক্লামাইডিয়া | বিশেষ কোনো উপসর্গই থাকে না | হ্যাঁ |
সংক্রমণ ছাড়াও
১. অপুষ্টি
২. পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার অভাব
৩. বিভিন্ন অসুস্থ অবস্থা যেমন: ডায়েবেটিস (বহুমুত্র রোগ), এইডস
৪. বিভিন্ন ঔষধ সেবনে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যেমন : জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি সেবন, এন্টিবায়োটিক সেবন অস্বাভাবিক সাদাস্রাবের কারণ হিসেবে বিবেচ্য।
প্রতিকার
১. এ সমস্যা কেন হয় এ বিষয়ে নারীদের ধারণার ব্যাপকতা সম্পর্কে নারীপক্ষ’র গবেষণায় দেখা যায়: ৫৩.৪% মনে করেন এটি ছোঁয়াচে না। ৪০.৬% বলছেন এটি ছোঁয়াচে। যারা ভাবছেন এটি ছোঁয়াচে না তারা বলেছেন, এটি বংশগত, অধিক পরিশ্রম, পুষ্টিহীনতা, পঁচা বা বাসী খাবার খাওয়া, বেশি বাচ্চা জন্ম দেয়া, জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি ও সুঁই ব্যবহারের কারণে হয়। যারা ভাবছেন এটি ছোঁয়াচে তারা বলেছেন, ব্যক্তিগত পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার অভাব, অনিরাপদ পানি ব্যবহার, একে অন্যের কাপড় পরা, সবাই একই থালাবাটি ব্যবহার করা, এটি যে ছোঁয়াচে সে বিষয় না জানা, অনেকেই বলেছেন স্বামীর সাথে সহবাসের কারণে তারা সংক্রমিত হচ্ছে। দু’একটি জায়গা ছাড়া (বংশগত ও সবাই একই থালাবাটি ব্যবহার করা) দু’ধরনের মতামতই সঠিক ও বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। সেজন্য দু’ধরনের মতামতকে সমান গুরুত্ব দেয়া দরকার।
২. প্রতিকারের জন্য তারা কি ধরনের উদ্যোগ নিয়েছেন জানতে চাইলে ৪১.৭% বলেন, তারা তেমন কোনো উদ্যোগ নেননি। বাকিরা গরম পানি, লবণ পানি, জীবাণুনাশক, মেহেদি পাতা ও নিম পাতার বড়ি, অর্জুনের ছাল ব্যবহার করেছেন; কেউ কেউ এ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি বা কবিরাজি চিকিৎসা নিয়েছেন। কেউ কেউ ব্যক্তিগত পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ও নিরাপদ যৌন সহবাসের বিষয়ে সচেতন ছিলেন। এ বিষয়ে বলা যেতে পারে, এর মধ্যে কিছু কিছু উদ্যোগ সাময়িক আরাম দিতে পারে, তবে পুরোপুরি সুস্থ হওয়া ও ভালো থাকার জন্য পুষ্টিকর খাবারের কোনো বিকল্প নাই। সাথে সাথে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা অপরিহার্য এবং মনে রাখতে হবে, যেহেতু এটি বিভিন্ন ধরনের জীবাণু দ্বারা হয়ে থাকে তাই ব্যাক্টেরিয়া, ফাংগাস ও অন্যান্য জীবাণু প্রতিরোধক সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নিতে হবে। জেনে রাখা ভাল; বেশি মাত্রায় গরম পানি, জীবাণুনাশক, লবণ পানি, মেহেদি, নিমপাতা, অর্জুনের ছালের ব্যবহার যোনিপথের স্বাভাবিক অম্লতা ও নিয়মিত ব্যাক্টেরিয়াকে ধ্বংস করে যোনিপথের সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে।
প্রতিকারের জন্য যে কয়েকটি বিষয় সুনির্দিষ্টভাবে গুরুত্ব দেয়া দরকার তা হচ্ছে-
১. মেয়েদের পরিমিত পুষ্টিকর খাবার খাওয়া দরকার। প্রতিদিন আমিষ জাতীয় খাবার যেমন মাছ, মাংস, ডিম, খিচুড়ি, ডাল ও ভিটামিন যুক্ত খাবার যেমন শাকসব্জি, ফলমূল বিশেষ করে টকফল এবং প্রচুর পরিমাণ পানি খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে পুষ্টিকর খাবার মানে দামি খাবার নয় বরং সহজ প্রাপ্য ও খাদ্যগুণ সমৃদ্ধ খাবার।
২. পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বিশেষ করে নিরাপদ পানি ব্যবহার, মাসিকের সময় পরিষ্কার জীবাণুমুক্ত কাপড়/প্যাড ব্যবহার, প্রতি ৬ ঘণ্টা পর পর অবশ্যই কাপড়/প্যাড পরিবর্তন ও জীবাণুমক্ত করা। মাসিকের পর ব্যবহার্য কাপড় পুনরায় ব্যবহার না করা ভালো তবে করতে হলে তা গরম পানিতে জীবাণুমুক্ত করে ভালো করে রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে।
৩. সংক্রমণ প্রতিরোধে সহবাসের ক্ষেত্রে কনডম ব্যবহার করা ভালো। আজকাল মেয়েদের কনডমও পাওয়া যায়। সহবাসের পর যথাসম্ভব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হওয়া বাঞ্ছনীয়।
৪. জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে পুরুষদের দায়িত্বশীল হতে হবে। পুরুষরা যদি কনডম ব্যবহার করেন তাহলে নারীদের জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি/সুঁই ব্যবহার কমে যাবে এবং সাদাস্রাব জনিত সমস্যাও কমে যাবে। জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি/সুঁই ব্যবহারে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।
৫. জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি/সুঁই বা এন্টিবায়োটিক ওষুধ সেবনকালে একটু বেশি পুষ্টিকর খাবার যেমন- দুধ, দৈ, ছানা, পায়েস, সেমাই ও খিচুড়ি খেতে হবে।
৬. সাদাস্রাবের পরিমাণ, রং, ঘনত্ব ও গন্ধ অস্বাভাবিক মনে হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র যেমন ইউনিয়ন পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র, স্যাটেলাইট ক্লিনিক বা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যেতে হবে এবং চিকিৎসকের উপদেশ অনুযায়ী নিয়মিত ওষুধ সেবন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে ছড়ায় এমন সংক্রমণের ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী বা যৌনসঙ্গীর একসঙ্গে চিকিৎসা নেয়া দরকার, নতুবা পুনরায় সংক্রমিত হতে পারে।
৭. সাদাস্রাবের সমস্যা মোটেই বংশগত নয় এবং চিকিৎসা করালে পরিপূর্ণ নিরাময় সম্ভব।
৮. মেয়েদের নিজেদের শরীরের প্রতি যত্নশীল হতে হবে। নিজের জন্য কিছুটা সময় রাখতে হবে। নিজের ভালোমন্দ নিজেকে বুঝতে হবে। তাহলে সুস্থ থাকা অনেকখানি সহজ হবে।