Select Page
২০২২-১১-০৫
“আর কতকাল চলেব এই প্রসূতি মৃত্যু?”

২৮ মে আন্তর্জাতিক নারীস্বাস্থ্য দিবস

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে সমুদ্রপাড়ের একটি প্রত্যন্ত জেলা বরগুনা। এই জেলার পাথরঘাটা উপজেলার বড়ইতলা গ্রামের রোকসানা বেগম (২০ বছর) প্রচন্ড প্রসব বেদনা নিয়ে ১২ এপ্রিল ২০০৪ রাত দশটায় পাথরঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি প্রসূতি সেবা কেন্দ্রে আসেন। প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সেখানকার সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক রোগীকে দ্রুত বরিশাল মেডিকেলে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। কারণ এই রোগীকে প্রসব করানোর উপযোগী চিকিৎসা ব্যবস্থা এ হাসপাতালে নেই। কিন্তু একেই তো প্রায় মধ্যরাত, তার ওপরে রোগীর এই অবস্থা! তাছাড়া পাথরঘাটা থেকে বরিশালে যাওয়ার রাস্তার প্রায় ১৫ কিলোমিটার পথের যা অবস্থা তা স্বাভাবিক মানুষেরও চলাচলের অযোগ্য। তার ওপরে আছে যানবাহন সমস্যা। সর্বোপরি যে সমস্যা তাহলো, রোগীর পরিবার আর্থিকভাবে স্বচ্ছল নয় একেবারেই। কাজেই রোগীর সঙ্গে আসা অসহায় আত্মীয়-স্বজন এই হাসপাতালেই প্রসব করানোর জন্য চিকিৎসক-নার্সদের অনুরোধ করেন। চিকিৎসক-নার্স সর্বাত্মক প্রচেষ্টা আর অক্লান্ত পরিশ্রম দিয়ে রাত চারটায় রোগীকে প্রসব বেদনা মুক্ত করেন। কিন্তু সকলের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে রোকসানা বেগম একটি মৃত শিশুর জন্ম দেন। রোগীর আত্মীয়-স্বজন অবশ্য চিকিৎসক-নার্সদের কাছে এতেই কৃতজ্ঞ যে, অন্তত মা বেঁচে আছে। এরকম অবস্থায় মাকেও অনেক সময়ই বাঁচানো সম্ভব হয় না। আর সে কারণেই বাংলাদেশে এখনো শুধুমাত্র গর্ভধারণ ও প্রসবজনিত জটিলতায় প্রতি ঘন্টায় ৩ জন নারী মারা যান। জন্ম হয় অসংখ্য মৃত শিশুর।

০ বাংলাদেশে ১৯৯০ সালে মাতৃ মৃত্যুহার ছিল প্রতি এক হাজারে ৬ জন। বর্তমানে এই হার প্রতি হাজারে ৪ জন এর কাছাকাছি (তথ্যসূত্র: বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো)
০ গর্ভধারণ ও প্রসবজনিত কারণে বাংলাদেশে প্রতি ঘন্টায় ৩ জন নারীর মৃত্যু হয়
০ গর্ভকালীন সময়ে শতকরা ১৫ জন নারীই নানাবিধ ঝুঁকিপূর্ণ জটিলতায় ভোগেন
০ যেসব নারী গর্ভকালীন সময়ে নানাবিধ জটিলতায় ভোগেন তার মাত্র শতকরা ২৬ জন স্বাস্থ্যসেবা নিতে আসেন।

কিন্তু কেন? সে কি কেবলই দারিদ্র্য, নাকি এর পেছনে রয়েছে সিদ্ধান্তহীনতা বা দেরীতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সময়মত হাসপাতালে না আসা, গর্ভাবস্থায় নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ না নেয়া, গর্ভবতী মায়ের পুষ্টিহীনতা এবং সরকারের হাসপাতালগুলোতে প্রয়োজনীয় জরুরি প্রসূতি সেবার ব্যবস্থা না থাকা? না কি এ সব ই এর জন্য দায়ি?

নারীস্বাস্থ্য বলতে যে বিষয়টি অত্যধিক গুরুত্ব পায় তা হচ্ছে তার প্রজনন স্বাস্থ্য। একজন নারীর সমাজে এবং পরিবারে প্রধান ও প্রথম কর্তব্য সন্তান জন্ম দেয়া; এটাই সমাজে প্রতিষ্ঠিত ধারণা। বাংলাদেশে এখনো প্রতিবছর ১৮ হাজার নারী মারা যায় কেবলমাত্র গর্ভধারণ সংক্রান্ত জটিলতায়। এই জটিলতায় ভোগে আরো ৬ লক্ষ নারী। বাংলাদেশে অধিক মাতৃ মৃত্যুহারের কথা বিবেচনা করে নারীপক্ষসহ অন্যান্য নারী আন্দোলন কর্মীরা ‘আন্তর্জাতিক নারী স্বাস্থ্য দিবসে’ নিরাপদ প্রসবের বিষয়টিকে সরকার ও জনসমক্ষে বিশেষ দাবী হিসেবে তুলে ধরে।

নিরাপদ প্রসব সংক্রান্ত বিশেষ স্মৃতিরক্ষণ অনুষ্ঠানের প্রেক্ষিতে ১৯৯৭ সালে সরকার এই দিনটিকে ‘নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস’ হিসাবে ঘোষণা এবং বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এতদসত্ত্বেও বাংলাদেশে মাতৃ মৃত্যুহারে উল্লেখযোগ্য কোন পরিবর্তন হয়নি।
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী প্রতিটি নাগরিকের অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব।

আন্তর্জাতিক নারী স্বাস্থ্য দিবস ২০০৪ পালনের প্রাক্কালে মাত্র দেড় মাস আগে সংঘিটত পাথরঘাটার যে ঘটনা এখানে উল্লেখ করা হয়েছে, তা বাংলাদেশের কোন বিচ্ছিন্ন অঞ্চলের একটি বিশেষ ঘটনা নয়। প্রতিনিয়তই দেশের উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে এমনটি ঘটছে।

সন্তান ধারণ ও জন্মদানের মাধ্যমে মানব প্রজন্ম রক্ষার গুরু দায়িত্বটি পালন করতে গিয়ে রোকসানার মত এমন অসংখ্য নারীকে যে স্বাস্থ্য ঝুঁকি, এমন কি মৃত্যু ঝুঁকি পর্যন্ত বহন করতে হয় তার দায়ভার পরিবার, সমাজ এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রের ওপরই বর্তায়, কারণ প্রজনন স্বাস্থ্যের নিরাপত্তা এবং প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া প্রতিটি নারীর সাংবিধানিক অধিকার। এই অধিকার পূরণ করতে সরকার বাধ্য। বাংলাদেশ সরকার অবশ্য জরুরি প্রসূতি সেবা নিশ্চিত করার জন্য ইতোমধ্যে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, যেমন:

০ জরুরি প্রসূতি সেবার বিস্তৃতি ঘটিয়ে ২০০৩ সাল নাগাদ জেলা প্রতি দুইটি সেবাকেন্দ্র সেই সাথে ৫৯টি জেলা হাসপাতাল এবং ১২০টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জরুরি প্রসূতি সেবাকেন্দ্র স্থাপন করে গর্ভবতী ও প্রসূতি মা’দের পর্যাপ্ত প্রসূতি স্বাস্থ্যসেবার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা
০ প্রয়োজনীয় জরুরি প্রসূতি সেবার সুযোগ বৃদ্ধি, রেফারেল-এর উন্নয়ন ও সেবাসমূহের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা
০ নারী ও কিশোরীদের পুষ্টিমান উন্নত করা
০ উপযুক্ত ও দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তিদেরকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবার সকল ক্ষেত্রে মানসম্পন্ন প্রসূতি সেবা নিশ্চিত করা।

যদিও এখনো দেশের সবগুলো উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জরুরি প্রসূতি সেবাকেন্দ্র চালু হয়নি, যেগুলোতে হয়েছে সেখানেই বা কী ঘটছে?

বাংলাদেশ সরকার ‘নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিতকরণ’ কর্মসূচী গ্রহণ করলেও মাঠ পর্যবেক্ষণে জরুরি প্রসূতি সেবাসহ অন্যান্য কার্যক্রম তেমন অর্থবহ বা কার্যকরী মনে হয় না, বিশেষ করে উপজেলা পর্যায়ে ও ইউনিয়ন বা গ্রাম পর্যায়ে। জরুরি প্রসূতি সেবা নিশ্চিত করার জন্য যে সামগ্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করা দরকার ছিল সেভাবে প্রচেষ্টা নেয়া হয়নি। যদিও জনগণ গত দশ বছরে অনেক সচেতন হয়েছে কিন্তু সরকারী সেবা প্রতিষ্ঠানসমূহ তেমন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারছে না। এই সকল প্রতিষ্ঠানে রয়েছে নানা অব্যবস্থা ও অপর্যাপ্ততা।

নারীপক্ষ পরিচালিত একটি স্বাস্থ্য বিষয়ক গবেষণা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তাহলো: সরকারের জরুরি প্রসূতি সেবা (EOC) কার্যক্রমের অধীনে ২৮ এপ্রিল ২০০৩ তারিখে পাথরঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি প্রসূতি সেবাকেন্দ্রটির উদ্বোধন করেন জেলা সিভিল সার্জন। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স চত্বরে একটি মনোরম জায়গায় ইউনিসেফ এর আর্থিক সহায়তায় তৈরি এই ভবনটির চাকচিক্য যথেষ্ট মনোহর। ভবনে সেবা প্রদানের উপযোগী পৃথক কক্ষ, অস্ত্রোপচার কক্ষ সবকিছুই ঠিকঠাক মত আছে। সেবা প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম এসেছে এই কেন্দ্র উদ্বোধনের বেশ কয়েক মাস আগেই, যার অনেকগুলো ইতোমধ্যে মরিচা ধরে নষ্ট হয়ে গেছে। অস্ত্রোপচার কক্ষে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রও লাগানো হয়েছে কিন্তু একবার বৃষ্টি হওয়ার পরেই দেখা গেলো এই যন্ত্রের বাইরের অংশের গা বেয়ে বৃষ্টির পানি ভেতরে ঢুকে অস্ত্রোপচার কক্ষ ভেসে যাচ্ছে। বারান্দায় পানি থৈ থৈ করছে। পানি নেমে যাওয়ার কোন ব্যবস্থা নেই। অন্যদিকে এই কেন্দ্রর জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত গাইনী চিকিৎসক তখন এক বছরের একটি প্রশিক্ষণে আছেন। নার্সরাই প্রসব করান; প্রয়োজনে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকগণ সহায়তা করেন। সরকারের বিশাল অংকের অর্থ ব্যয়ে একটি মহৎ উদ্দেশ্য (গ্রাম অঞ্চলের প্রসূতি নারীদের নিরাপদ এবং নিশ্চিত স্বাস্থ্যসেবা প্রদান) নিয়ে যে সেবাকেন্দ্রটি চালু হলো তার এই যে বেহাল অবস্থা সেটা দেখাও সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে।

নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসক তার এক বছরের প্রশিক্ষণ শেষে ২৯ নভেম্বর ২০০৩ কাজে যোগদান করেন কিন্তু তার কয়েক মাস আগেই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এ্যানেস্থেটিস্ট এখান থেকে বদলী হয়ে চলে যান; কারণ, তখন তার কোন কাজ ছিলো না এই হাসপাতালে। তার স্থলে নতুন কোন এ্যানেস্থেটিস্ট আজ পর্যন্ত আসেননি। কাজেই জরুরি প্রসূতি সেবাকেন্দ্রে সিজারিয়ান অস্ত্রোপচার ব্যবস্থা আজও পর্যন্ত করা যায়নি।

০ স্বাস্থ্য অধিকার মানুষের একটি মৌলিক অধিকার। এটি নিশ্চিত করার জন্য চারটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেগুলির মধ্যে রয়েছে-
ক) পর্যাপ্ত পরিমাণ চিকিৎসা উপকরণ সরবরাহ নিশ্চিত করা
খ) স্বাস্থ্যসেবার গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করা
গ) স্বাস্থ্যসেবা দান কেন্দ্রে সকলের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা
ঘ) চিকিৎসা সেবার গুণগতমান নিশ্চিত করা।
০ প্রসবজনিত প্রতিটি মৃত্যুর মৌখিক ময়না তদন্ত হওয়া আবশ্যক। তাহলেই জানা যাবে কোথায় বাধা, কোথায় বিলম্ব এবং সেই সাথে সচেতন হবেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীগণ।

কাহিনীর এখানেই শেষ নয়। যদিও সেই চিকিৎসককে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে প্রসূতি চিকিৎসায়, বিশেষত সিজারিয়ান অস্ত্রোপচার বিষয়, কিন্তু প্রশিক্ষণ শেষে তাকে কাজে যোগ দিতে হয়েছে উক্ত স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা (MRO) হিসেবে। অর্থাৎ তাকে এখন বেশীরভাগ সময়ই ব্যস্ত থাকতে হয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রশাসনিক কাজে এবং সাধারণ রোগীদের চিকিৎসার কাজে। কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কোন ব্যাখ্যা দেননি বলে জানিয়েছেন সেই চিকিৎসক। এক বছরের প্রশিক্ষণকাল তিনি সিজারিয়ান অস্ত্রোপচার সম্পর্কে যে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন তা এখন আর কোন কাজেই লাগাতে পারছেন না এ্যানেস্থেটিস্ট না থাকার কারণে। ফলে তিনি যেমন তার দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা ভুলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন এবং পেশাগত হতাশায় ভুগছেন তেমনি রোকসানার মতো অনেক প্রসূতিই প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। জন্ম দিচ্ছেন মৃত সন্তানের। অনেক সময় নিজেও শিকার হচ্ছেন একটি অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর। এর দায়-দায়িত্ব কার?

সরকারের বহু অর্থ ব্যয়ে একজন চিকিৎসক তৈরি হন। এই মেধা ও দক্ষতার উপর পূর্ণ দাবি আছে জনগণের। মেধা ও দক্ষতার এই যে অপচয় ও অপব্যবহারের ফলে রোকসানার মতো মায়েরা তাদের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হন এবং জন্ম হয় এই মৃত শিশুদের সে দায়-দায়িত্বও সরকারের উপরই বর্তায়।

Pin It on Pinterest

Share This