একটি প্রচলিত প্রবাদ আছে, ‘বাবার নাম নিলে দুধে-ভাতে খায়, মায়ের নাম নিয়ে ছাইয়ের তলে যায়।’
মায়ের শরীরের রক্ত মাংস দিয়ে তিল তিল করে ক্ষুদ্র একটি ভ্রুণ একটি পরিপূর্ণ মানবশিশুতে পরিণত হয়। অপরিসীম যন্ত্রণা সহ্য করে একজন মা শিশুটিকে পৃথিবীর আলোতে নিয়ে আসেন, জন্মের পরে শিশুর মুখে প্রথম খাদ্য (বুকের দুধ) তুলে দেন এবং নিজের সবটুকু শক্তি ও সামর্থ ব্যয় করে সন্তানকে একটি পূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেন। সন্তানের পরিচিতিতে সেই মায়ের নাম উচ্চারণ করলে সন্তানের অমঙ্গল হবে আর বাবার নাম নিলে সন্তান সুখে থাকবে এমন চিন্তা নারীকে কেবল অসম্মানই করে না তার অধিকারকেও অস্বীকার করে। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার কারণেই এই চিন্তা-চেতনা হাজার হাজার বছর ধরে আমাদের সমাজে প্রচলিত রয়েছে। আজ এ ধারণা পরিবর্তনের সময় এসেছে।
বর্তমানে প্রচলিত অভিভাবকত্ব আইনটি প্রণীত হয়েছে ১৮৯০ সালে অর্থাৎ এখন থেকে ১১১ বছর আগে। এ আইনে সন্তানের স্বাভাবিক অভিভাবক হন বাবা অথবা বাবার অনুপস্থিতিতে দাদা বা চাচা অর্থাৎ, বাবার পক্ষের একজন পুরুষ। এ আইনে একজন নারী কোন অবস্থায়ই সন্তানের স্বাভাবিক অভিভাবক নন, তিনি কেবণ সন্তানের লালন পালনের দায়িত্ব (জিম্মাদারিত্ব) পান।
এ আইটি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী। এ আইন নারীর অধিকার যেমন খর্ব করেছে তেমনি এ আইনে রয়েছে অনেক অসঙ্গতি। প্রচলিত অভিভাবকত্ব আইন নারী পুরুষকে সমান অধিকার দেয়নি। এ আইনে সন্তানের অভিভাবকত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রে যে বিষয়টির প্রতি সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দেয়া হয়েছে তা হলো, অভিভাবকত্ব যিনি দাবি করেন সন্তানকে ভরণ-পোষণ দেবার ক্ষমতা তার আছে কিনা। এখন অনেক নারী উার্জনক্ষম। অনেক নারী সন্তানের ভরণ-পোষণ দেয়া সহ যাবতীয় দায়িত্ব বহন করে থাকনে, কিন্তু তারপরেও তিনি সন্তানের অভিভাবকত্ব পান না। অন্য দিকে অনেক বাবাই সন্তানের ভরণ-পোষণ দেন না বা দিতে অপারগ, তারপরেও তিনি সন্তানের বৈধ অভিভাবক। কাজেরই অভিভাবকত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রে ভরণ-পোষণ দেওয়ার সামর্থই প্রধান বিবেচ্য বিষয় হওয়া উচিৎ নয়। আর হলেও তা নারী পুরুষ সবার ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য হওয়া উচিৎ। আবার, বর্তমানে প্রচলিত অভিবাবকত্ব আইনে যখন কোন নারী সন্তানের জিম্মাদায়িত্ব চেয়ে আদালতের কাছে যান, তখন ঐ নারীর চারিত্রিক ত্রুটি-বিচ্যুতির কথাও প্রমাণ করবার চেষ্টা করা হয় যা কোন পুরুষের ক্ষেত্রে সাধারণত হয় না। এক্ষেত্রেও রয়েছে বৈচষম্য। বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশ যেমন: তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, তিউনিসিয়া প্রভৃতি দেশে ইতমধ্যে পারিবারিক আইনে পরিবর্তন আনা হয়েছে। মুসলিম আইনের পাশাপাশি অন্যান্য ধর্মভিত্তিক আইনেও বিভিন্ন দেশে সংস্কার করা হয়েছে এবং হচ্ছে; যেমন, ১৯৫৫ ও ১৯৫৬ সালে ভাতে চিন্দু পারিবারিক আইনে পরিবর্তন আনা হয়েছে। ১৯৬১ সালে মুসলিম পারিবারিক আইনে এ ধরনের বেশ কিছু পরিবর্তন আন হয়েছে।
বর্তমানে প্রচলিত অভিভাবকত্ব আইনের পরিবর্তন সময়ের দাবি। সবচেয়ে বড় কথা হলো আইন তৈরি হয় মানুষের অধিকার রক্ষ ও মানুষের কল্যাণের জন্য। পুরুষ ও নারী উভয়ই মানুষ সুতরাং নারীর অধিকার রক্ষা এবং সন্তানের কল্যাণের জন্য বর্তমান অভিভাবকত্ব আইনের পরিবর্তণ একান্ত দরকার।
আমাদের সংবিধানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, দেশের নারী-পুরুষ, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবাই সমান অধিকার ভোগ করবে নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণ সনদ (সিডিও)-এর ১৬ (চ) ধারায় সন্তানের অভিভাবকত্বের ক্ষেত্রে পিতা মাতা উভয়য়ের সমান অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে যা বাংলাদেশ সরকার অনুসমর্থন করেছে। শিশু অধিকার সনদেও বলা হয়েছে, সন্তান মা-বাবা উভয়ের স্নেহ ভালোবাসায় লালিত পালিত হবে। এছাড়া ১৯৯৯ সালের সরকারী ঘোষণা অনুযায়ী দু’হাজার সাল থেকে সন্তানের পরিচিতির ক্ষেত্রে বাবার নামের পাশাপাশি মায়ের নাম লেখার নিয়মও চালূ হয়। কিন্তু এই নিয়ম কেবল মাত্র কিছু কিছু স্কুলে কার্যকর হচ্ছে। এই নিয়ম সর্বত্র কার্যকর হোক এটা যেমন আমরা চাই সেই সঙ্গে আমরা চাই, সন্তানের অভিভাবকত্বের ক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি নারীও পূর্ণ অধিকার অর্জন করুক। তাই বর্তমানে প্রচলিত অভিভাবকত্ব আইন পরিবর্তনের লক্ষ্যে আমাদের দাবিঃ
* সন্তান যেহেতু মা-বাবা দু’জনের এবং সংবিধানে নারী-পুরুষ সকলের সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে তাই উভয়ের অধিকার রক্ষা এবং সন্তানের কল্যঅণের স্বার্থে অভিভাবকত্ব আইনে মা-বাবা দু’জনের সমান অধিকার থাকতে হবে।
* মা বা বাবার মধ্যে যিনি সক্ষম তিনই সন্তানের ভরণ-পোষণ দেবেন। উভয়ে সক্ষম হলে উভয়েই দেবেন।