লিফলেট
মুক্তিযুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের স্মরণে ১৯৮৮ সাল থেকে প্রতি বছরের মত এবারও বিজয় দিবসের প্রাক্কালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নারীপক্ষ আয়োজন করেছে আলোর স্মরণে কাটুক আঁধার’ অনুষ্ঠান। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ”দিশেহারা বাংলাদেশ : পথ খুঁজে পেতেই হবে।
একটি স্বাধীন-সার্বভৌম গণতান্ত্রিক দেশ প্রতিষ্ঠার যে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, নীতি-আদর্শ এবং আকাঙ্ক্ষায় মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিলো তা আজ ধুলায় লুন্ঠিত। স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তাটুকুও আর নেই। এর মূলে রয়েছে আদর্শবিবর্জিত, কেবল ক্ষমতাসর্বশ্য ও যেন-তেন প্রকারে অর্থ-বিত্ত লাভের রাজনীতি। রাষ্ট্রযন্ত্র শিকার দল বা ব্যক্তিবিশেষের স্বেচ্ছাচারি আগ্রাসনের। রাষ্ট্র ও সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে অসততা, দুর্নীতি, দুরাচার। জনগণ আজ বিপর্যস্ত, হতাশ এবং ভীত। দেশ আজ দিশেহারা।
আমরা ”ভোটাধিকার” প্রয়োগের মাধ্যমে দেশ পরিচালনার দায়িত্বভার কোন না কোন রাজনৈতিক দলকে দিয়েছি কিন্তু ক্ষমতার পালাবদলে তাদের কেউই দেশের সাধরণ জনতার স্বার্থে দেশ পরিচালনা করেছে বলে প্রতীয়মান হয়নি। অপরদিকে আমরা নাগরিকরা ভোট দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছি। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা দেশ চালনার দায়িত্বটি যথাযথভাবে পালন করছে কি না, সে বিষয়ে সজাগ থাকিনি।
আর বিলম্ব নয়। আসুন সহিংসতা, অপশাসন ও দুর্নীতিমুক্ত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে আমরা তৎপর হই। নিজে উদ্যোগী হই, অন্যের উদ্যোগে সামিল হই। মুক্তিযুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের স্মরণে মোমবাতির আলো জ্বালিয়ে নিজেদের আলোকিত করি। দূর করি রাষ্ট্র ও সমাজের সকল অনিয়ম-দুর্নীতি ও অসততার অন্ধকার।
ঘোষণাপত্র
বিজয় দিবসকে সামনে রেখে মুক্তিযুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের স্মরণে নারীপক্ষ’র নিবেদন ‘আলোর স্মরণে কাটুক আঁধার’। আজ আমরা শ্রদ্ধার সাথে আরো স্মরণ করছি নারীপক্ষ’র প্রয়াত সদস্য নাসরীন হককে, যাঁর উদ্যোগ ও কর্মস্পৃহায় ১৯৮৮ সালে এই অনুষ্ঠানের সূচনা হয়েছিল। পঁচিশ বছর ধরে প্রতিবছর আমরা এই অনুষ্ঠান করে আসছি। আমাদের এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় “দিশেহারা বাংলাদেশ : পথ খুঁজে পেতেই হবে।”
দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের পথ বেয়ে লক্ষ প্রাণ আর অসংখ্য মানুষের ত্যাগ-তিতিক্ষা, লাঞ্ছনা-অপমান-নির্যাতনের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছি। এজন্য আমাদের দিতে হয়েছে অনেক মূল্য, হারাতে হয়েছে অনেক স্বজনকে। মুক্তিযুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া সেই সকল স্বজনের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাতে আমরা প্রতি বছর এভাবে মিলিত হই।
কোন বিশেষ শ্রেণি-গোষ্ঠী বা ব্যক্তি নয়, দেশের প্রতিটি মানুষের জানমালের নিরাপত্তা, জীবন-জীবিকার নিশ্চয়তা এবং সর্বোপরি একটি স্বাধীন-সার্বভৌম গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিক হিসেবে সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার অধিকার প্রতিষ্ঠার যে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, নীতি-আদর্শ এবং আকাংক্ষায় আমরা ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম তা আজ ধুলায় লুন্ঠিত। স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তাটুকুও আজ আর নেই। এই সবকিছুর মূলে রয়েছে আদর্শবিবর্জিত, কেবল ক্ষমতাসর্বশঃ এবং যেন-তেন প্রকারে অর্থ-বিত্ত লাভের রাজনীতি।
একটি দেশের সার্বিক বিনির্মাণের মূল চাবিকাঠী সেই দেশের জাতীয় রাজনীতি এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতি। সেই রাজনীতি যখন কলুষিত হয় তখন গণতন্ত্র ভূলুণ্ঠিত হয়, দেশ হয় দিশেহারা। একটি শ্রেণি তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে সবকিছু নিজেদের দখলে রাখে। রাষ্ট্রযন্ত্র- তথা বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ এবং প্রশাসন শিকার হয় দল বা ব্যক্তিবিশেষের স্বেচ্ছাচারি আগ্রাসনের। রাষ্ট্র ও সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ে অসততা, দুর্নীতি, দুরাচার। তোষামোদি আর চাটুকারদের দৌরাতেœ্য সাধারণ জনতা হয় বিপর্যস্ত, হতাশ এবং ভীত। যার এক জ্বলন্ত উদাহরণ আজকের বাংলাদেশ। ক্ষমতাসীন এবং ক্ষমতা লাভে চেষ্টারত- এই উভয় পক্ষই গণতন্ত্রের অপব্যাখ্যা, অপচর্চা করে ক্ষমতার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে সাধারণ জনগণকে জিম্মি করে। গণতন্ত্রের যে প্রকৃত রূপ- “শাসন ব্যবস্থা হবে জনগণের, জনগণ কর্তৃক এবং জনগণের জন্য,” তা আজ পর্যবশিত হয়েছে “জনগণকে অবরুদ্ধ করে, জনগণকে বোকা বানিয়ে, জনগণকে ক্রয় করে” ক্ষমতা দখলের অশুভ লড়াইয়ে। মাঝে পড়ে পিষ্ট হচ্ছে সেই জনতাই। মরছে মানুষ, পুড়ছে মানুষ, ধুকছে মানুষ ! প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।
’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানি শোষণ থেকে মুক্ত হয়ে দেশ পরিচালনার জন্য আমরা নিজস্ব প্রতিনিধি নির্বাচন করেছি। ক্ষমতায় বসিয়েছি কোন না কোন রাজনৈতিক দলকে কিন্তু তারা দেশের সকল জনতার স্বার্থে দেশ পরিচালনা করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। দল এবং ব্যক্তির স্বার্থে অধিক থেকে অধিকতর ক্ষমতা, অর্থ-বিত্ত লাভের নেশায় দেশ পরিচালনা করেছে। আমরা নাগরিকরা ভোট দিয়েই যেন সকল দায়িত্ব শেষ করেছি ! নির্বাচিত প্রতিনিধিরা জনগণের স্বার্থে দেশ পরিচালনা করছে কি না সে বিষয়ে সজাগ থাকিনি।
অপরদিকে সমাজ ও রাষ্ট্রের শোষণ-বৈষম্য দূর করে জনগণের স্বার্থে, মানুষের কল্যাণে, শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য যে রাজনীতির প্রয়োজন তার সম্ভাবনা আজ ক্ষীণপ্রায়। বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে থাকা নীতি-আদর্শবান গুটিকয় রাজনীতিকরা দল কিংবা সমাজে হয়ে আছেন কোনঠাসা। জাতীয় সমস্যা-সঙ্কট উত্তরণে তারা আজ আর কোন ভূমিকাই রাখতে পারছেন না। ফলে দুষ্টচক্র নির্বিঘেœ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বত্র।
গত ৪২ বছরে আমরা ৯টি জাতীয় সংসদ পেয়েছি। আজ আরো একটি জাতীয় নির্বাচন আমাদের দ্বারপ্রান্তে। একতরফা নির্বাচনের পায়তারা রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য অশনি সংকেত। এই নির্বাচন যদি সকল দল ও ব্যাপক জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন হয় তাহলেও কি নাগরিক জীবনের সমস্যা-সঙ্কট দূর হবে ? জনগণের জান-মাল ও জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে ? অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, ক্ষমতার পালাবদলে যারাই ক্ষমতায় আসেন, আর যারাই বিরোধী দলে থাকেন, সাধারণ জনতা সদাসর্বদা নিষ্পেষণ ও বঞ্চনার শিকার হয়। এই অবস্থা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতেই হবে।
আর বিলম্ব নয়। আসুন সহিংসতা, অপশাসন ও দুর্নীতিমুক্ত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে আমরা তৎপর হই। নিজে উদ্যোগী হই, অন্যের উদ্যোগে সামিল হই। ইতিমধ্যে গৃহীত উদ্যোগসমূহকে আরো জোড়ালোভাবে এগিয়ে নিতে সহযোগিতা করি। মুক্তিযুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের স্মরণে যে মোমবাতির আলো আমরা জ্বেলেছি সেই আলোয় নিজেদের আলোকিত করি, দূর করি রাষ্ট্র ও সমাজের সকল অনিয়ম-দুর্নীতি ও অসততার অন্ধকার।
নারীপক্ষ
স্থান : কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার
সময় : বিকাল ৫:১৫ থেকে সন্ধ্যা ৬:৩০
তারিখ : শনিবার, ২৩ অগ্রহায়ণ ১৪২০/৭ ডিসেম্বর ২০১৩