ঘোষণাপত্র
আনন্দ, বেদনা ও বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিজয় অর্জন করেছি এবং এর জন্য বাংলাদেশের মানুষকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে, হারাতে হয়েছে অসংখ্য স্বজন। মুক্তিযুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া সেই স্বজনদের স্মরণ করতে নারীপক্ষ ১৯৮৮ সাল থেকে বিজয় দিবসের প্রাক্কালে একটি নির্দিষ্ট প্রতিপাদ্য নিয়ে আয়োজন করে আসছে “আলোর স্মরণে কাটুক আঁধার” অনুষ্ঠান। এবারের প্রতিপাদ্য “মানবিক রাষ্ট্র চাই।”
মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যাশা ছিল একটি বৈষম্যহীন স্বাধীন সার্বভৌম মানবিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, যে রাষ্ট্রে প্রত্যেক নাগরিক সমান মর্যাদার দাবিদার। নারী-পুরুষ নর্বিশিষেে সকল জাতি গোষ্ঠি, ধর্মীয় সম্প্রদায়, বিভিন্ন ভৌগোলিক অবস্থানে বসবাসকারী মানুষ সহ সকলের থাকবে সমান অধিকার। রাষ্ট্রের কাছে নাগরিক পরিচয়ই হবে বড় পরিচয়। মানবিক রাষ্ট্র সকল নাগরিকের জান ও মালের নিরাপত্তা রক্ষা করবে, রাষ্ট্র তার নাগরিকদের সকল মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করবে। শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখবে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি বিকাশের সুযোগ দেবে। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পারিপার্র্শি¦ক অবস্থা স্থিতিশীল রাখবে। আইনের শাসন বজায় রাখবে। মানবিক রাষ্ট্র নৃ-তাত্ত্বিক পরিচয়, গোষ্ঠী, শ্রেণী, লঙ্গি বা যৌন পরিচয়, ধর্ম বশ্বিাস নির্বিশেষে সকল নাগরিককে সমান চোখে দেখবে। কোন বিশেষ ধর্মের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করবে না। শাররিকি বা বুদ্ধি প্রতবিন্ধীদরে জন্য থাকবে বশিষে সুবধিা ।
একটি মানবিক রাষ্ট্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বৈষম্যহীন সমাজ নির্মাণ। আমাদের সংবিধানের ২৮নং অনুচ্ছেদেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্যহীন ব্যবস্থার কথা বলা আছে। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ একটি প্রগতিশীল চিন্তা চেতনার ভিত্তিতে সংবিধান রচনা এবং বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিলেও প্রকৃতপক্ষে সকল উদ্যোগ শুরুতেই স্তিমিত হয়েছে। এপর্যন্ত ১৬ বার সংবিধানকে পরিবর্তন পরিবর্ধন করে সংবিধানের মৌলিক আদর্শকে ক্ষুন্ন করা হয়েছে। বাক স্বাধীনতা বর্তমানে শুন্যের কোঠায়। মুক্ত চিন্তা চেতনার সকল দ্বার বর্তমানে রুদ্ধ। বাংলাদেশ ‘নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্যবিলোপ’ সনদে স্বাক্ষর করেছে, যে সনদের মূল ভিত্তিই হচ্ছে লঙ্গি ভদেে বৈষম্যহীনতা। কিন্তু নারীর প্রতি বৈষম্য দুর হয়নি। গত কয়েক দশকের তুলনায় চলাফেরার স্বাধীনতায় এত বাধা ও বিপত্তি ইতিপূর্বে দেখা যায়নি। বিশেষভাবে নারীর চলা ফেরার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা তো নাই বরং দিন দিন নারীর চলাচল নানাবধি হুমকরি মুখে পড়ছে। নারীরা নিজ নিজ পেশা ও কাজের প্রয়োজনে বাইরে যাতাতের ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে গণপরিবহন ব্যবহার করছিল কিন্তু বর্তমানে গণপরিবহনে যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা ঘটায় নারীর চলাচল নতুন করে ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে। নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি একদিকে যেমন নারীর স্বাধীন চলাফেরাকে বাধাগ্রস্থ করছে অন্যদিকে নিরাপত্তাহীনতা ও আইনের শাসনের নি¤œগতি এই বাধা বিপত্তিকে আরো প্রকট করে তুলছে। নারীসহ সকল নাগরিকেরই জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। ১৯৯৭ সালে ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘদিনের সহিংস অস্থিতিশীলতা ও বিরোধের নিষ্পত্তির জন্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু ২১ বছরেও এর পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি। অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র মানবিকবোধকে ও মানবিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যকে জলাঞ্জলি দিয়ে ক্রস ফায়ারের নামে নাগরিকদের হত্যা করছে ও অভিযুক্তদের হেফাজতে থাকা অবস্থায় মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে অহরহ। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা সত্ত্বেও বিচার বহির্ভূত এসব হত্যা বন্ধ হচ্ছে না। তাছাড়া বিচারিক প্রক্রিয়ার মধ্যেও নাগরিককে মৃত্যুদন্ড দেয়া মানবিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য নয়। নাগরিকের জীবনের অধিকার সংরক্ষণ করা মানবিক রাষ্টের দায়িত্ব। অপরাধীকে সংশোধন করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব, তার জীবন সংহার নয়। নাগরিকের জীবন নেওয়া মানে রাষ্ট্রের নৈতিক স্খলন। একজন হত্যাকারী সমাজ, মানুষ ও আইনের চোখে ঘৃণ্য অপরাধী, ঠিক সেই কাজটি যখন রাষ্ট্র করে তখন রাষ্ট্রই অপরাধীর ভূমিকায় থাকে। তখন সেই রাষ্ট্রকে মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য করা যায় না।
মুক্তিযুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া দেশমাতৃকার স্বজনরা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে আমাদের স্বজন হয়ে থাকবে এবং আমরা আজ সেসব স্বজনদের স্মরণ করতেই এখানে সমবেত হয়েছি। দেশ মাতৃকার স্বজনদের স্মরণে আজ যে আলো আপনারা জ্বালিয়েছেন আসুন সে আলোয় আমরা নিজেদের আলোকিত করি, প্রত্যেকে প্রত্যেকের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বলীয়ান হয়ে জোর আওয়াজ তুলি, আমরা চাই মর্যাদাপূর্ণ নাগরিক জীবন, আমরা চাই জীবনের অধিকার, চাই একটি মানবিক রাষ্ট্র।
নারীপক্ষ