ঘোষণাপত্র
ডিসেম্বর মাস বিজয়ের মাস, আনন্দের মাস, বেদনার মাস। ১৯৭১ সালের এই মাসে আমরা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছি। এর জন্য আমাদের অনেক মূল্য দিতে হয়েছে, হারাতে হয়েছে অসংখ্য স্বজন। হারিয়ে যাওয়া সেই স্বজনদের স্মরণ করতে ১৯৮৮ সাল থেকে বিজয় দিবসের প্রাক্কালে একটি নির্দিষ্ট প্রতিপাদ্য নিয়ে নারীপক্ষ’র আয়োজন “আলোর স্মরণে কাটুক আঁধার” অনুষ্ঠান। এবারের প্রতিপাদ্য “৭১ এ আমরা, আর ’১৭ এ রোহিঙ্গা: প্রেক্ষাপটের ভিন্নতা ও অভিন্নতা।”
নাসরীন হক, নারীপক্ষ’র প্রয়াত সদস্য। তাঁর উদ্যোগে এই অনুষ্ঠানের সূচনা হয়েছিলো। আজ আমরা তাঁকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। আমরা নিশ্চিতভাবে জানি, এই সময়ে নাসরীন হক বেঁচে থাকলে তিনি তাঁর সর্বশক্তি নিয়ে অসহায়, নিপীড়িত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পাশে দাঁড়াতেন; তাদের সমস্যা সমাধানে ছুটে বেড়াতেন দেশ-বিদেশের সর্বমহলে। অপরিসীম উদ্যমী ও প্রচন্ড সাহসী এই মানুষটির অভাব আমরা আজ বড় বেশী অনুভব করছি।
বাংলাদেশে বর্তমান রোহিঙ্গা শরণার্থী পরিস্থিতি আমাদেরকে ’৭১ এর সেই যুদ্ধাবস্থাকে মনে করিয়ে দেয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয় লাভ করা সত্ত্বেও তৎকালীণ পাকিস্তান সরকার শাসনভার হস্তান্তর করতে অস্বীকার করে। অসন্তোষ আর বিক্ষোভে ফুসে ওঠে জনতা। তাদেরকে স্তব্ধ করে দিতে পাকিস্তানি বর্বর হানাদার বাহিনী ২৫ মার্চ ১৯৭১, রাতের অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র মানুষের উপর এবং চালাতে থাকে নির্মম হত্যাযজ্ঞ আর তান্ডবলীলা। মার্চ-ডিসেম্বর জুরে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের দ্বারা চলতে থাকে দেশের মানুষের উপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ, জ্বালাও-পোড়াও, লুটতরাজ, ধর্ষণ, নির্যাতন, নিপীড়ন।
একইভাবে গত ২৫ আগস্ট ২০১৭ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযানে সাধারণ মানুষের উপর আবারও আক্রমণ, নির্যাতন, ধর্ষণ, জ্বালাও-পোড়াও শুরু হয় এবং তা অব্যাহতভাবে চলতে থাকে। পরিকল্পিত এ অভিযানে বেসামরিক নাগরিকরাও অংশ নেয় বলে অভিযোগ রয়েছে। নিপীড়িত ও নিরাশ্রয় এই রোহিঙ্গারা দলে দলে বাংলাদেশে আসতে থাকে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনের তথ্যমতে ২৫ আগস্ট-২২ নভেম্বর ২০১৭ পর্যন্ত ৬ লাখ ২৪ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এই সংখ্যা ক্রমশঃ বেড়েই চলেছে। এছাড়া, আগে থেকেই বাড়িঘর থেকে বিতাড়িত ও নির্যাতনের শিকার কয়েক লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজার অঞ্চলে অবস্থান করছে। এই বিশাল সংখ্যক শরণার্থীদের একটা বড় অংশ নারী ও শিশু। এদের মধ্যে আছে হাজার হাজার গর্ভবতী নারী। ইতিমধ্যেই তাদের অনেকে সন্তান প্রসব করেছেন। কী হবে এই সকল শিশুর ভবিষ্যত? ’৭১ এর যুদ্ধপরিস্থিতিতে দেশের প্রায় এক কোটি মানুষ ভারতে বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল তবে তারা জানত, দেশ স্বাধীন হলেই তারা নিজ ভূমিতে ফিরে আসবে কিন্তু রোহিঙ্গা শরণার্থীরা জানেনা যে, তারা আর কখনোই নিজ দেশে ফিরতে পারবে কি না!
সত্তর ও নব্বইয়ের দশকে মিয়ানমার সরকার দুই দফায় তাদের দেশের রাখাইন অঞ্চলে বসবাসরত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা চালায়। তখনও বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল। দফায় দফায় আলোচনা ও চুক্তির পরও বাংলাদেশে আসা সেই সকল রোহিঙ্গাকে এখনো ফেরত পাঠানো যায়নি। এ বছর ২৫ আগস্ট তাদের উপর হামলা ছিল আরও ব্যাপক ও নির্মম। মিয়ানমারের এই সেনা অভিযানকে এরইমধ্যে জাতিসংঘ এবং যুক্তরাষ্ট্র “জাতিগত নিধন” বলে অভিহিত করেছে, যা আন্তর্জাতিক আইনে মানবতাবিরোধী অপরাধ। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারসহ অনেকেই এই পরিস্থিতিতে গণহত্যা বা জেনোসাইড এর উপাদান রয়েছে বলে অভিমত প্রকাশ করেছে।
১৯৯৪ সালের মে মাসে জাতিসংঘের একটি কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, উদ্দেশ্যমূলক নীতি ও কর্মকৌশল দ্বারা যদি কোনো জাতিগোষ্ঠী বা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতি অন্য কোনো জাতিগোষ্ঠী বা ধর্মীয় সম্প্রদায় বৈরী আচরণ করে এবং তাদের নির্মূলের অভিযান চালায়, তবে সেটা “জাতিগত নিধন”। এ সংজ্ঞা অনুযায়ী মিয়ানমার সরকারকে এখন আন্তর্জাতিক আইনে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো যায়।
’৭১ এ দেশের সর্বস্তরের মানুষ স্বাধীনতার স্বপ্ন নিয়ে প্রতিবাদে-প্রতিরোধে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সামিল হয় মুক্তিযুদ্ধে। ফলশ্রুতি, স্বাধীন বাংলাদেশ। ১৯৮২ সালে মিয়ানমার সরকার আইন করে সেদেশের রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করে তাদেরকে পরিচয়হীন, রাষ্ট্রহীন করে ফেলে! এমন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের, বিশেষত নারী ও শিশুদের শারীরিক, মানসিকসহ সার্বিক নিরাপত্তা, সুরক্ষা ও স্বস্তি নিশ্চিত করতে নারীপক্ষ জোড়ালোভাবে দাবি জানাচ্ছে। নারীপক্ষ আরো দাবি জানাচ্ছে,
* মিয়ানমার সরকারকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পূর্ণ নাগরিকত্ব দিয়ে ফিরিয়ে নিতে হবে এবং তাদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে
* মিয়ানমার জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র, তাই জাতিসংঘকেও রাষ্ট্রটির সকল সম্প্রদায়কে নিরাপত্তা ও পূর্ণ নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে দায়িত্ব নিতে হবে
* রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর যে গণহত্যা ও বর্বরতা চালানো হয়েছে, এর বিচারের দাবিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সোচ্চার থাকতে হবে ও বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
মানবিক কারণে বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছে, এ জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ সরকারকে নারীপক্ষ সাধুবাদ জানায়। সমস্যাটির সমাধান মিয়ানমারকেই করতে হবে; তবে আমাদের প্রত্যাশা, বাংলাদেশ সরকার এই সমস্যা বিচক্ষণতার সাথে মোকাবেলা করবে এবং বিশ্বসম্প্রদায়কে রোহিঙ্গাদের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াবে।
নারীপক্ষ মুক্তিযুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের স্মরণে আয়োজিত “আলোর স্মরণে কাটুক আঁধার” অনুষ্ঠানে আপনাকে যোগ দিয়ে মোমবাতি জ্বালানোর আহ্বান জানাচ্ছে। আসুন, মুক্তিযুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের স্মরণে এই আলো জ্বালিয়ে আমরা নিজেদের আলোকিত করি, প্রত্যেকে প্রত্যেকের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বলীয়ান হয়ে রোহিঙ্গাদের সমস্যা নিরসনে জোর আওয়াজ তুলি, বিশ্ববিবেক জাগ্রত করি।
স্থান : কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার
দিন-ক্ষণ : মঙ্গলবার, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪২৪/১২ ডিসেম্বর ২০১৭, বিকাল ৫:১৫ থেকে সন্ধ্যা ৬:৩০
নারীপক্ষ
জিপিও বক্স-৭২৩, ঢাকা-১০০০,