ঘোষণাপত্র
মুক্তিযুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের স্মরণে ১৯৮৮ সাল থেকে প্রতি বছরের মতো এবারও বিজয় দিবসের প্রাক্কালে নারীপক্ষ আয়োজন করেছে “আলোর স্মরণে কাটুক আঁধার” অনুষ্ঠান। এবারের প্রতিপাদ্য “ধর্মীয়, জাতিগত এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তাসহ সকল অধিকার সুরক্ষা করুন।”
ডিসেম্বর মাস বিজয়ের মাস, আনন্দের মাস, বেদনার মাস। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে আমরা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছি এবং বিশ্ব মানচিত্রে অঙ্কিত হয়েছে আমাদের স্বাধীন অবস্থান। এর জন্য আমাদের অনেক মূল্য দিতে হয়েছে, হারাতে হয়েছে অসংখ্য স্বজন। হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের স্মরণ করতে প্রতিবছর আমরা এভাবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমবেত হই।
নাসরীন হক, নারীপক্ষ’র প্রয়াত সদস্য। তাঁর উদ্যোগে এই অনুষ্ঠানের সূচনা হয়েছিলো। আজ আমরা তাঁকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে নাসরীন এর মতো উদ্যমী ও সাহসী মানুষের অভাব আমরা বড় বেশী অনুভব করছি।
আজ ৯ ডিসেম্বর, রোকেয়া দিবস। ধর্মের দোহাই ও রক্ষণশীল সমাজের চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে বেগম রোকেয়া নারীকে সকল প্রকার জ্ঞানের আলো পেতে এবং গৃহাভ্যন্তরের বাইরে বেরিয়ে আসতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তাঁর আলোকবর্তিকা যুগে যুগে নারীমুক্তির লড়াই ও মানুষে মানুষে সম্প্রীতি রক্ষার পথে আলো ছড়াবে। আমরা আজ তাঁকে এই অনুষ্ঠানে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।
স্বাধীনতার জন্য, মুক্তির জন্য, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য শ্রেণি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে এদেশের মানুষ ’৭১ এ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। স্বপ্ন ছিল মানুষে মানুষে বিভেদহীন ধর্মনিরপেক্ষ এক স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠা কিন্তু সেই স্বপ্নের দেশ কি আমরা পেয়েছি? ধর্মগত, ভাষাগত, জাতি-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়গতভাবে যাঁরা অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও সংখ্যায় কম বা প্রান্তিক অবস্থানে আছেন তাঁদের উপর প্রতিনিয়ত ঘটছে নানা ধরনের নির্যাতন-নিপীড়ন এবং মাঝে মাঝেই তা সহিংস আক্রমণে রূপ নিচ্ছে। তাঁদের উপাসনালয়ে হামলা ও ভাঙচুর, বাড়িঘর পোড়ানো, মালামাল লুটপাট, জায়গা-জমি ও সম্পত্তি দখল, নারী ধর্ষণ ও যৌনআক্রমণ – এমনকি প্রাণে মেরে ফেলা! এর সাম্প্রতিক উদাহরণ নাসিরনগর, ঠাকুরগাঁও, যশোর, ফেনী, পিরোজপুর, দিনাজপুর, নেত্রকোনা, …. ও গোবিন্দগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটে যাওয়া ঘটনা।
৩০ অক্টোবর ২০১৬, ইসলাম ধর্মকে অবমাননার অভিযোগ তুলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসির নগরে ১৫টির অধিক মন্দিরে হামলা ও প্রতিমা ভাঙচুর এবং হিন্দুদের অসংখ্য বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। ৪ নভেম্বর ২০১৬, পুলিশি প্রহরার মধ্যেই পুনরায় সেখানে হিন্দুদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করা হয়। একই দিন ঠাকুরগাঁও, যশোর, ফেনী, পিরোজপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে একই রকম হামলার ঘটনা ঘটে। ২ ডিসেম্বর ২০১৬, দিনাজপুরের বোচাগঞ্জ উপজেলার সেতাবগঞ্জে গভীর রাতে হিন্দু সম্প্রদায়ের ১০টি পরিবারের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ৫ ডিসেম্বর ২০১৬, নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে একটি মন্দিরে আগুন দিয়ে পাঁচটি প্রতিমা পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এখনও বিরামহীনভাবে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ঘটেই চলেছে এই ধরনের ঘটনা।
৬ নভেম্বর ২০১৬ গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জের সাঁওতাল অধ্যুষিত মাদারপুর গ্রামে পুলিশ এবং স্থানীয় মাস্তান বাহিনী বর্বরোচিত হামলা ও অগ্নিসংযোগ এবং মালামাল লুটপাট করে। এতে ছয়শতাধিক ঘরবাড়ি পুড়ে যায় এবং সেখানকার অন্ততঃপক্ষে তিনজন সাঁওতাল পুরুষ নিহত ও বহু সংখ্যক মারাতœক আহত হন, গ্রেফতার হন অনেকে। তারা এখনো অসহায় আতঙ্কিত দিনাতিপাত করছেন। এইসকল ঘটনার বাইরেও এ দেশে ধর্মগত, ভাষাগত, জাতি-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়গতভাবে অপেক্ষাকৃত দুর্বলদের উপর প্রতিনিয়ত নানা রকম নিপীড়ন চলে, যা হয়তো সেভাবে জনসমক্ষে আসে না বা প্রকাশ পায় না।
নারীপক্ষ এই সকল ঘটনায় অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত। ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, ভূমি দস্যুদের দাপট, পুলিশ-প্রশাসনের মদত এবং দেশে আইনের শাসনের অভাব ও বিচারহীনতা এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তির জন্য দায়ী। এইসব ঘটনার সাথে সরকারি দলের নেতাকর্মীদের সম্পৃক্ততা এবং তাদের অপরাধ আড়াল করার চেষ্টায় আমরা আরো বেশী উদ্বিগ্ন।
গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা এই চারটি স্তম্ভকে ভিত্তি করে ১৯৭২ সালে রচিত হয়েছিল বাংলাদেশের ‘সংবিধান’। বিভিন্ন সময়ে শাসকগোষ্ঠী বার বার এই সংবিধানে নানা সংযোজন ও বিয়োজন করেছে। সংবিধান থেকে বিলীন হয়েছে ‘ধর্ম-নিরপেক্ষতা’ ও ‘সমাজতন্ত্র’। ১৯৮৮ সালে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ‘রাষ্ট্রধর্ম’ ঘোষণায় রাষ্ট্রের সাথে ধর্মের সম্পর্ক স্থাপিত হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্র্ম ইসলামকে ‘রাষ্ট্রধর্ম’ করে সংখ্যালঘু ধর্মাবলম্বীদের সম-নাগরিকত্ব ক্ষুন্ন করা হয়। বাজার অর্থনীতির নীতিমালা ঘোষণার মধ্য দিয়ে সমাজতন্ত্রের স্তম্ভটিও বিলীন হয়েছে।
নারী-পুরুষ, ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকলের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ও ত্যাগে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে প্রতিটি মানুষ নিরাপদে, নির্বিঘেœ ও স্বাধীনভাবে বসবাস করবে, নিজস্ব ধর্ম পালন করবে, তার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে লালন, ধারণ ও বহন করবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা। সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকার সুরক্ষা করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। তাই সরকারের কাছে আমাদের দাবি, “ধর্মীয়, জাতিগত এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তাসহ সকল অধিকার সুরক্ষা করুন।”
দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতা নিশ্চিত করার সর্বাধিক দায়িত্ব সরকারের, তথাপি আমাদের সজাগ থাকতে হবে, যাতে সারকার এই দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে না পারে। একইসাথে আমাদের একে অপরের পাশে দাঁড়াবার মানসিকতা তৈরি করতে হবে, মানুষে মানুষে সম্প্রীতির বন্ধনকে সুদৃঢ় করতে হবে।
আসুন, মুক্তিযুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের স্মরণে আজ এখানে প্রজ্জ্বলিত মোমবাতির আলোয়ে আমরা নিজেদের আলোকিত করি; প্রত্যেকে প্রত্যেকের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হই; গড়ে তুলি একটি মুক্তমনা, অসাম্প্রদায়িক এবং সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ।
স্থান : কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার
দিন-ক্ষণ : শুক্রবার, ২৫ অগ্রহায়ণ ১৪২৩/৯ ডিসেম্বর ২০১৬, বিকাল ৫:১৫ থেকে সন্ধ্যা ৬:৩০
নারীপক্ষ
জিপিও বক্স-৭২৩, ঢাকা-১০০০