১৬ ডিসেম্বর আমাদের জন্য যেমন আনন্দ ও গর্বের তেমন বেদনারও, কারণ এই বিজয়ের জন্য আমাদের অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে, হারাতে হয়েছে অসংখ্য স্বজন। হারিয়ে যাওয়া সেই স্বজনদের স্মরণে নারীপক্ষ ১৯৮৮ সাল থেকে প্রতিবছর বিজয় দিবসের প্রাক্কালে একেকটি প্রতিপাদ্য নিয়ে “আলোর স্মরণে কাটুক আঁধার” অনুষ্ঠান আয়োজন করে আসছে। এবারের প্রতিপাদ্য “একাত্তরের যুদ্ধসন্তানদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি।”
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন প্রায় পুরোটা সময়ই পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের দ্বারা দেশের মানুষের উপর চলতে থাকে নির্মম হত্যাযজ্ঞ, জ্বালাও-পোড়াও, লুটতরাজ, ধর্ষণ, নির্যাতন, নিপীড়ন। এই অত্যাচারের ক্ষত এখনও আমাদের স্মৃতিতে দগদগে হয়ে আছে। অনেকের জীবন তছনছ হয়ে গেছে এবং অনেকের জীবনের বাঁক চিরতরে ঘুরে গেছে। সবচেয়ে বড় এবং কঠিন আঘাত বহন করে চলেছেন আমাদের বীরাঙ্গনা বোনেরা। তাঁরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে উপেক্ষিত, অনুপস্থিত এবং তাদের অস্তিত্বকে অন্ধকারে রেখে দেয়া হয়েছে। তাঁদের উপর হওয়া যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের ফলে তাঁদের অনেকের গর্ভধারণ, গর্ভপাত ও প্রসবের ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে যেমন সামান্য উল্লেখ ছাড়া কোন স্থান পায়নি তেমন বাস্তব জীবনে তাঁরা তাঁদের পরিবারে, সমাজে আশ্রয় পায়নি। আমরা এই নারীদের সবার খোঁজ জানিনা, যেমনটা জানিনা শহীদ এবং নিখোঁজ হওয়া সকল মানুষের খোঁজ। দেশ স্বাধীনের পরে তাদের সেই গর্ভজাত যুদ্ধসন্তানদের পারিবারিক, সামাজিক, এমনকি রাষ্ট্রীয়ভাবেও পরিত্যাগ করা হয়। এই যুদ্ধসন্তানদের অনেকে তাঁদের মায়ের আশ্রয়ও পায়নি। অনেককে দেশান্তরিত হতে হয়েছে দত্তক হিসেবে, আর যাঁরা দেশেই আছেন তাঁদের যুদ্ধসন্তান পরিচয়ের কারণে প্রতিনিয়ত অবহেলা, অপমান ও নিগ্রহের শিকার হতে হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে।
মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যাশা ছিল একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, যেখানে ন্যায়, নীতি ও ইনসাফ হবে একটি মূলমন্ত্র এবং যে রাষ্ট্রে প্রতিটি মানুষের জীবনের অধিকার সংরক্ষিত থাকবে; কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, স্বাধীনতার ৫০ বছরেও আমাদের সেই প্রত্যাশিত রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এটা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, আমাদের যুদ্ধসন্তানরা আজও নিজ দেশে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিটুকু পায়নি! স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির প্রাক্কালে নারীপক্ষ সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছে, দত্তকসূত্রে বিদেশে অবস্থানরত সকল যুদ্ধসন্তানকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করার জন্য উন্মুক্ত আহবান জানানো হোক এবং রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির মাধ্যমে দেশে বসবাসরত যুদ্ধসন্তানদের পরিচয়কে সম্মানসূচক অবস্থানে স্থাপন করা হোক।
এছাড়াও, নারীপক্ষ একটি বৈশ্বিক আহবানের মধ্য দিয়ে যুদ্ধসন্তানদের জন্ম অধিকার প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদানের আহবান জানাচ্ছে।
প্রতি বছরের মতো নারীপক্ষ এবারও আপনাকে মুক্তিযুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের স্মরণে আয়োজিত “আলোর স্মরণে কাটুক আঁধার” অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে মোমবাতি জ্বালানোর আহŸান জানাচ্ছে। এই আলো ব্যক্তির, সমাজের ও রাষ্ট্রের সকল অন্ধকারকে দূর করুক। যুদ্ধসন্তানদের নিয়ে ইতিহাসের অলিখিত অধ্যায়কে আলোকিত করুক। দেশে বিদেশে অবস্থানরত যুদ্ধসন্তানরা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং তাদের জন্ম অধিকার পাক।
দিনক্ষণ: ২৫ অগ্রহায়ণ ১৪২৮/১০ ডিসেম্বর ২০২১, শুক্রবার বিকাল ৫:২০ থেকে সন্ধ্যা ৬:৩০
স্থান: কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার
নারীপক্ষ