ঘোষণাপত্র
দীর্ঘদিনের সংগ্রামের সোপানে রচিত হয়েছে বাংলাদেশের মুক্তির ইতিহাস। ৫২, ৬৯, ৭১ এবং তার পরবর্তী প্রতিটি আন্দোলনে বাংলার মানুষের রণ হুংকার রুখে দিয়েছে অত্যাচারীর সকল পথকে। শোষণ-বঞ্চনা-নিপীড়নের অচলায়তনের বিরম্নদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার সর্বোজ্জ্বল মাইলফলক একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। শিশু-কিশোর, যুবক-বৃদ্ধ, নারী-পুরুনষ নির্বিশেষে সকল ধর্ম বর্ণের মানুষ এই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। স্বদেশকে করেছিল শত্রুমুক্ত। বিনিময়ে সহ্য করেছে ধ্বংস, হত্যা, ধর্ষণ এবং স্বজন হারানোর বেদনা। আপনজন হারানোর যন্ত্রণা ও বিজয়ের অনুভূতি নিয়ে শহীদ স্মরণে প্রতিবারের মত এবারও নারীপক্ষ আয়োজন করেছে বিশেষ স্মরণ অনুষ্ঠান “আলোর স্মরণে কাটুক আঁধার”। আজকের স্মরণ অনুষ্ঠানের বিষয় ‘শিশু স্মৃতিতে মুক্তিযুদ্ধ’।
বাংলাদেশের প্রায় সকল আন্দোলনে শিশুদের অংশগ্রহণ এবং তাদের দুঃসাহসিক আত্মদানের গৌরবময় উপাখ্যান রয়েছে। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে এদেশের অনেক শিশু নানাভাবে সম্পৃক্ত হয়েছে। গৌরবময় সেই উপাখ্যানকে আজকের প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার লক্ষেই এই আয়োজন।
আমাদের শিশু যারা ১৮ বছরের নীচে, ’৭১ এ লড়াই করেছে একটি স্বাধীন আবাসভূমির জন্যে, আন্দোলনে অংশ নিয়েছে, মিছিলে যোগ দিয়েছে, শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত করেছে নতুন একটি মানচিত্র ও পতাকার জন্যে। বুলেটের মুখোমুখি হয়েছে সীমাহীন সাহসিকতায়। পাকিস্তানী সেনারা বেয়নেটে খুঁচিয়ে হত্যা করেছে শিশুদের, আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে তাদের। সারা বিশ্ব অবাক হয়ে চেয়ে দেখেছে বাংলার মানুষের সাহসিকতা।
পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর মেজর সিদ্দিক মালিক এর ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইটিতে নাম না জানা একটি শিশু মুক্তিযোদ্ধার কথা উল্লেখ আছে যে শত নির্যাতন ও অত্যাচার সহ্য করেও সহযোদ্ধাদের নাম ও পরিচয় প্রকাশ করেনি। বিনিময়ে রোহানপুরের সেই শিশু মুক্তিযোদ্ধা মৃত্যুকে বরণ করেছিল পাক সেনাদের হাতে। মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা খুদে মুক্তিযোদ্ধা টিটোর আর্তি ছিল ‘আমারে বাঁচান’, ‘আমি স্বাধীনতা দেখুম’। শামীমুর শামীম, তপন, আজাদ, মাসুদ, ফয়জুল ইসলাম, শহিদুর রহমান, সিদ্দিক, মোসলেহউদ্দীন, মোহাম্মদ শামীম, হাছেন আলী মিয়া, হাসান, মিয়া শওকত হোসেন, সারোয়ার হোসেন, তাহের দেওয়ান, আব্দুস সালাম, দৌলত আলী এরা সবাই শহীদ খুদে মুক্তিযোদ্ধা। এমনি আরো অনেক নাম না জানা শিশু মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে যাদের খবর আমরা রাখি না।
৭১ এর অগ্নি শিশুরা যে শুধু অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করছে তা নয়, বিভিন্নভাবে তারা এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। কেউ তথ্য দিয়ে, কেউ খাবার দিয়ে, কেউ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সে সময় মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করছে। শিশুদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে এদেশের কোমল মাটি। শিশুরা হয়েছে গৃহহীন, ভূমিহীন, দেশহীন; অনেকেই হয়েছে স্বজনহীন। শিশু বলে তাদেরকে রেহাই দেয়নি বর্বর পাকিস্তানী সেনারা। নারী শিশুরা হয়েছে ধর্ষণের শিকার। স্কুল থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া শিশুকে ধর্ষণের পর দু’পা ধরে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৩৩ বছর হয়ে গেল। সেদিনের মুক্তিযোদ্ধারা যে লক্ষে লড়াই করেছিল, সেই আদর্শ ও চেতনা আজ কোথায়? যে শিশুরা প্রাণ হারিয়েছে দেশ গড়ার লক্ষে সে দেশ কি আজ আমরা পেয়েছি? আজকের শিশুরা কি দেশ গড়ার প্রক্রিয়ায় সেই প্রেরণার সাথে যুক্ত হতে পারছে? যেমন শিশু মন থেকে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি হারিয়ে যায়নি, তেমনি আজকের শিশুদেরকেও দেশ গড়ার প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব। এই প্রত্যাশায় সেই মহৎ উদ্দেশ্যে সকলকে একাত্ম হয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
প্রতি বছরের মত তাই এবারও আমরা আলো জ্বালিয়েছি হারানো স্বজনদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে। এ আলো সব কিছুর উর্দ্ধে উঠে জাগিয়ে তুলুক মুক্তির প্রেরণাকে। দূর করুক সকল হিংসা বিদ্বেষ।
নারীপক্ষ
র্যাংগস নীলু স্কোয়ার (৫ম তলা), বাড়ী- ৭৫, সড়ক- ৫/এ, সাতমসজিদ রোড, ধানমন্ডি, ঢাকা-১২০৯, বাংলাদেশ
জিপিও বক্স-৭২৩, ঢাকা-১০০০, ফোন : ৮৮০-২-৮১১৯৯১৭, ৮১৫৩৯৬৭, ফ্যাক্স : ৮৮০-২-৮১১৬১৪৮
ই-মেইল : naripokkho@gmail.com, ওয়েব : www.naripokkho.com.bd
আলোর স্মরণে কাটুক আঁধার – ২০০৪