Select Page
২০১৪-১২-০৯
আলোর স্মরণে কাটুক আঁধার – ২০১৪

লিফলেট

মুক্তিযুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের স্মরণে ১৯৮৮ সাল থেকে প্রতি বছরের মতো এবারও বিজয় দিবসের প্রাক্কালে নারীপক্ষ আয়োজন করেছে আলোর স্মরণে কাটুক আঁধার অনুষ্ঠান। এবারের প্রতিপাদ্য বীরাঙ্গনা গাঁথা।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর কর্তৃক ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার নারীদের প্রতি সমাজ যাতে কোনরকম অসম্মান প্রদর্শন না করে সেজন্য তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান তাঁদের বীরাঙ্গনা উপাধি দিয়েছিলেন। হিতে বিপরীত হলো ; এই উপাধি তাঁদের জন্য অপমান, অপবাদ এবং লাঞ্ছনার কারণ হয়ে দাঁড়ালো।

আমাদের সমাজ-সংস্কৃতির চিরাচরিত দৃষ্টিভঙ্গি, যেকোন ধরনের যৌন নির্যাতন নারীর ইজ্জত বা সম্ভ্রমহানি ঘটায়। পরিবার ও সমাজ তাকেই অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে তাকে অপমান ও অপদস্থ করে। মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার নারীদের বেলায়ও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। বীরাঙ্গনার শারীরিক ও মানসিক ক্ষত এবং আর্থিক বিপর্যয় নিরাময়ে রাষ্ট্র কর্তৃক কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ জরুরী হলেও তা হয়নি, তাই আজও শুনতে হয় দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জনের কথা।

সম্প্রতি সরকার বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ; তাঁরা মুক্তিযোদ্ধাদের মতো সরকারী ভাতা পাবেন। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে এখনো বেঁচে থাকা বীরাঙ্গনাদের অর্থকষ্টের যন্ত্রণায় কিছুটা স্বস্তি আসবে। আমরা এজন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানাই; তবে আমরা মনে করি, নাম বা উপাধি বদলালে তাঁদের প্রতি সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তন হবে না। তাঁদেরকে দেয়া বীরাঙ্গনা উপাধির যথাযোগ্য মর্যাদা ও সম্মান রাষ্ট্রিয় উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করা অত্যাবশ্যক। সেইজন্য সামাজিক, মানসিক ও আর্থিক ক্ষতিপূরণার্থে তাঁদের পূর্ণ মর্যাদা প্রদান করার পক্ষে আমাদের দৃঢ় অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করছি। আমরা চাই, রাষ্ট্র এই বীরাঙ্গনাদের যথাযোগ্য সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করবে।

মুক্তিযুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের স্মরণে মোমবাতি জ্বালাবার আহবান জানাচ্ছে নারীপক্ষ। এই আলো মানুষের মনের সকল অন্ধকার, কুপমন্ডুকতা ও সঙ্কীর্ণতা দূর করে চিন্তা-চেতনাকে প্রসারিত করুক; ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার নারীকে দোষারোপ, অসম্মান-অপমান-অপদস্থ করার সংস্কৃতির অবসান ঘটাক।

ঘোষণাপত্র

মুক্তিযুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া মানুষের মুখ আমাদের স্মৃতিতে সর্বদা অমস্নান। হারিয়ে যাওয়া সেইসব স্বজনদের স্মরণে প্রতি বছরের মতো এবারও বিজয় দিবসের প্রাক্কালে নিবেদিত হচ্ছে নারীপক্ষর শ্রদ্ধাঞ্জলি আলোর স্মরণে কাটুক আঁধার। নারীপক্ষ ১৯৮৮ সাল থেকে প্রতিবছর একটি বিশেষ বিষয়কে তুলে ধরে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে। এবারের বিষয় বীরাঙ্গনা গাঁথা। আজ আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি নারীপক্ষর প্রয়াত সদস্য নাসরীন হককে, যাঁর উদ্যোগে এই অনুষ্ঠানের সূচনা হয়েছিল।

আজ ৯ ডিসেম্বর, রোকেয়া দিবস। বৈষম্য, বঞ্চনা, নিপীড়ন, নিগ্রহ, অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার নারীর পক্ষে যার সাহসী উচ্চারণ সমাজের বিবেককে নাড়া দিয়েছে, নারীমুক্তির সেই দূরদর্শী অগ্রসৈনিক রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন এর আজ জন্ম ও মৃত্যুদিবস। তাঁর রেখে যাওয়া আলোকবর্তিকাটি যুগ যুগ ধরে নারীমুক্তির পথে আলো ছড়িয়ে চলেছে। আমরা তাঁকেও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।

৭১- এর মুক্তিযুদ্ধ আমাদের প্রত্যেকের জীবনে যোগ করেছে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা । সেখানে মুক্তির আনন্দ এবং বীরগাঁথা যেমন আছে তেমনই রয়েছে অপরিসীম দু:খ-যন্ত্রণা, অত্যাচার-নির্যাতন, লাঞ্ছনা-বঞ্চনা। আছে আপনজন হারানোর বেদনা, শারিরীক ও মানসিক প্রতিবন্ধিত্ব নিয়ে বেঁচে থাকার কষ্ট ও বিড়ম্বনা। এই যুদ্ধে বহু নারী ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। যুদ্ধকালে এই নারীরা অবর্ণনীয় নির্যাতন সহ্য করেছেন; যুদ্ধ শেষে স্বাধীন বাংলাদেশেও তাঁদেরকে সইতে হয়েছে লাঞ্ছনা-গঞ্জনা, অপমান, অবহেলা, তাচ্ছিল্য ও বিদ্রুপ। রাষ্ট্রের অবহেলায়, রাজনৈতিক দল ও নীতিনির্ধারকদের মনোযোগের বাইরে, সামাজিক পীড়নে, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে পরিবার ও আপনজনদের কাছ থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে এক কোণে পড়ে থাকতে তাঁরা বাধ্য হয়েছেন। তাঁদের অবস্থা এবং অবস্থান সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য কোন ইতিহাস আজও লেখা হয়নি।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর কর্তৃক ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার নারীদের প্রতি সমাজ যাতে কোনরকম অসম্মান প্রদর্শন না করে সেজন্য তৎকালীন সরকার প্রধান তাঁদের বীরাঙ্গনা উপাধি দিয়েছিলেন। হিতে বিপরীত হলো ; এই উপাধি তাঁদের জন্য অপমান, অপবাদ এবং লাঞ্ছনার কারণ হয়ে দাঁড়ালো।

১৯৭২-৭৪ সালে সরকার বীরাঙ্গনাদের পুনর্বাসনের চেষ্টা করেছিল কিন্তু এক সময়ে পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলি বন্ধ এবং কোন স্বাক্ষ্য-প্রমান থাকলে তাঁদের জীবন আরও দুর্বিসহ হবে- এই ভ্রান্ত বিশ্বাসে বীরাঙ্গনাদের সকল দলিল-দস্তাবেজ ধ্বংস করা হয়। পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে এই নারীরা কেউ নিজ পরিবারে ফিরে গেছেন, কেউ দেশ ছেড়ে চলে গেছেন, অনেকে নতুন লোকালয়ে নতুন পরিচয় নিয়ে বেঁচে আছেন। যতদুর জানা যায় তাঁদের অনেকেই অতি দরিদ্র অবস্থায় গৃহকর্মীর কাজ বা ভিক্ষা করে এবং পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন একাকী জীবন যাপন করছেন; কেউ কেউ ইতিমধ্যে মারা গেছেন আর অনেকে নানা রোগে-শোকে ধুঁকে ধুঁকে দিনাতিপাত করছেন।

সম্প্রতি সরকার বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ; তাঁরা মুক্তিযোদ্ধাদের মতো সরকারী ভাতা পাবেন। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে এখনো বেঁচে থাকা বীরাঙ্গনাদের অর্থকষ্টের যন্ত্রণায় কিছুটা স্বস্তি আসবে। আমরা এজন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানাই; তবে আমরা মনে করি, নাম বা উপাধি বদলালে তাঁদের প্রতি সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তন হবে না। তাঁদেরকে দেয়া বীরাঙ্গনা উপাধির যথাযোগ্য মর্যাদা ও সম্মান রাষ্ট্রিয় উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করা অত্যাবশ্যক। সেইজন্য সামাজিক, মানসিক ও আর্থিক ক্ষতিপূরণার্থে তাঁদের পূর্ণ মর্যাদা প্রদান করার পক্ষে আমাদের দৃঢ় অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করছি। আমরা চাই, রাষ্ট্র এই বীরাঙ্গনাদের যথাযোগ্য সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করবে; পাশাপাশি তাঁদেরকে ‘মুক্তিযোদ্ধা ভাতা’ প্রদানের সিদ্ধান্ত অতি দ্রুত বাস্তবায়ন করবে। গত তেতালিস্নশ বছরে তাঁদের প্রাপ্য মর্যাদা ও সম্মান প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব পালনে আমরা সবাই ব্যর্থ। এই ব্যর্থতার গস্নানি আমাদের ব্যথিত করে, লজ্জিত করে। আমরা তাঁদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।

২০১১ সালে স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পূর্তিতে নারীপক্ষ একাত্তরের যে নারীদের ভুলেছি শীর্ষক কর্মসূচীর আওতায় বীরাঙ্গনা এর প্রাপ্য অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং বীরাঙ্গনা উপাধিকে অর্থবহ করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করে। এর পাশাপাশি ব্যক্তিগত অনুদান সংগ্রহ করে কয়েকজন বীরাঙ্গনাকে নিয়মিত আর্থিক সহায়তা প্রদান এবং গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র এর সহায়তায় বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

আমাদের সমাজ-সংস্কৃতির চিরাচরিত দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, যেকোন ধরনের যৌন নির্যাতন নারীর ইজ্জত বা সম্ভ্রমহানি ঘটায়। পরিবার ও সমাজ যৌন নির্যাতনের শিকার নারীকেই অপরাধী ভাবে এবং তাকে অপমান ও অপদস্থ করে। মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার নারীদের বেলায়ও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। আমরা মনে করি, ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন নিরেট অপরাধ; এর সাথে ইজ্জত বা সম্ভ্রমের কোন সম্পর্ক নেই। বীরাঙ্গনার শারীরিক ও মানসিক ক্ষত এবং আর্থিক বিপর্যয় নিরাময়ে রাষ্ট্র কর্তৃক কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ জরুরী হলেও তা হয়নি। এই অবস্থার পরিবর্তন হতেই হবে। সেই লক্ষ্যে, আমাদের দাবী :


• জাতীয় সংসদের অধিবেশনসহ সকল সরকারি অনুষ্ঠানের শুরুতে ৭১- এর বীরাঙ্গনাদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা এবং স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসের মতো জাতীয় অনুষ্ঠানসমূহে তাঁদের অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো ও তাঁদের জন্য সামনের সারিতে আসন বরাদ্দ করা হোক


• বীরাঙ্গনাদের প্রতি সরকারি-বেসরকারি সকল পর্যায়ে লিখনে, বলনে বা ভাষণে এবং শব্দ ও ভাষা ব্যবহারে ধর্ষিতা, ইজ্জতহানি, সম্ভ্রমহানি, ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার বন্ধ করা হোক, যথা সকল রাষ্ট্রিয় দলিল ও কার্যক্রম থেকে দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে … বা দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি … ধরনের কথা বাতিল করে সে স্থানে সরাসরি ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে অসংখ্য নারী ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন বাক্যটি ব্যবহার করা হোক


• স্বাধীনতার তেতাল্লিশ বছরেও বীরাঙ্গনাদের সম্মান, মর্যাদা ও আর্থিক সহায়তা প্রদানে ব্যর্থ হওয়ার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করা হোক


৭১- এর বীরাঙ্গনাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনার জন্য পাকিস্তান সরকারের প্রতি দাবি করা হোক।


• দরিদ্র ও অস্বচ্ছল বীরাঙ্গনাদের জন্য চিকিৎসা ও অন্যান্য সকল সুবিধাসহ সমন্বিত আবাসন ব্যবস্থা চালু করা হোক


• সকল সরকারী হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে বীরাঙ্গনাদের সকল ধরনের চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা করা হোক।


মুক্তিযুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের স্মরণে আজ আমরা এখানে মোমবাতির যে আলো জ্বেলেছি তা মানুষের মনের সকল অন্ধকার, কুপমন্ডুকতা ও সঙ্কীর্ণতা দূর করে চিন্তা-চেতনাকে প্রসারিত করুক; ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার নারীকে দোষারোপ, অসম্মান-অপমান-অপদস্থ করার সংস্কৃতির অবসান ঘটাক।

 

স্থান : কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার
সময় : বিকেল ৫:৩০ থেকে সন্ধ্যা ৭ :০০
তারিখ : মঙ্গলবার, ২৫ অগ্রহায়ণ ১৪২১/৯ ডিসেম্বর ২০১৪

Pin It on Pinterest

Share This