ভূমিকা: নারীর প্রতি বৈষম্যের ব্যাপকতা ও গভীরতার কারণে নারী নিজ ঘরে, বাইরে বা কর্মক্ষেত্রসহ সর্বত্র অনিরাপদ। নারী জীবনব্যাপী শারীরিক, মানসিক, যৌন, ইত্যাদি বহুমাত্রিক সহিংসতার শিকার হয়। যুদ্ধ এবং সংঘাতকালে নারীর উপর অধিকতর সহিংসতা হয়। ফলশ্রæতিতে নারীর স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্থ হয় এবং সে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থানসহ অন্যান্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৫ সালের জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশে বিবাহিত নারীদের ৬৪% শারীরিক, ৩৬% যৌন, ৮১% মানসিক এবং ৫৩% অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। দৈনিক প্রথম আলোর (২০২২) সুত্রমতে পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৮ সাল থেকে প্রতিবছরই নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা বেড়েছে। এর মধ্যে করোনা সংক্রমণের দুই বছরে ২০২০ সালে সবচেয়ে বেশি ৩৯ শতাংশ এবং ২০২১ সালে ৩৬ শতাংশ বেশি মামলা হয়।
পুলিশ সদর দপ্তর সুত্রমতে জানুুৃয়ারি – অক্টোবর ২০২২ পর্যন্ত নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে ৯,৭৬৪টি মামলা হয়েছে। এরমধ্যে ধর্ষণের মামলা প্রায় অর্ধেক, অর্থাৎ ৪,৩৬০টি। সাইবারক্রাইম এওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের জরিপমতে ১৮ থেকে ৪০ বছরের ৫০% নারী সাইবার হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হয়।
নারীপক্ষ জন্মলগ্ন থেকেই এ বিষয়ে প্রতিবাদ, গবেষণা, বিষয়ভিত্তিক প্রচারপত্র, পোষ্টার ও বিভিন্ন কর্মসুচি গ্রহণ করেছে এবং যুক্ত হয়েছে দেশ-বিদেশের বৃহত্তর আন্দোলনে। নারীপক্ষ ১৯৮৫ সালে জনসম¥ুখে অবস্থান তুলে ধরে যে, পারিবারিক সহিংসতা নারীর ব্যক্তিগত বিষয় নয় বরং এটি নারীর রাজনৈতিক অধিকারের বিষয়।
১৯৯৫ সালে বেইজিং এ অনুষ্ঠিত ৪র্থ বিশ^ নারী সম্মেলনের পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে ৩০০ নারী সংগঠনের সাথে ধারাবাহিক কর্মশালায় নারীর উপর সহিংসতা ও নারীর মানবাধিকার ছিল উল্লেখ্যযোগ্য বিষয়। এর প্রেক্ষিতেই নারী সংগঠনদের নিয়ে গড়ে উঠে ‘দুর্বার’ নামে একটি নেটওয়ার্ক।
‘দুর্বার’ দেশব্যাপী সহিংসতা মোকাবেলা এবং প্রতিরোধে সরকারি প্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতা, ভুক্তভোগী নারী ও তার পরিবারকে সহায়তা করাসহ স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত আন্দোলন গড়ে তোলে। এছাড়াও নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ( সিডও) এর ছায়া ও বিকল্প প্রতিবেদন তৈরিতে নারীপক্ষ মুখ্য ভুমিকা রেখেছে। সহিংসতা প্রতিরোধে নানা কর্মসূচির মধ্যে নারীর মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিয়ে কাউন্সেলিং সেবা শুরু করেছিল।
নারীর উপর সহিংসতা সম্পর্কিত আইন ও নীতিমালা- যেমন নারী উন্নয়ন নীতিমালা, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধনী ২০০৩), এসিড অপরাধ দমন আইন ২০০২ ও এসিড নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০২, পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন ২০১০ ইত্যাদি প্রণয়নে নারীপক্ষ সক্রিয় ভুমিকা রাখে।
যেহেতু নারীর উপর সহিংসতা নারীর জীবন-জীবিকা, নারীর বেঁচে থাকার উপর হুমকি এবং চরম মানবাধিকার লংঘন সেহেতু নারীপক্ষ আগামী পাঁচ (৫) বৎসরের জন্য নি¤েœাক্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
উদ্দেশ্য:
নারীর উপর সহিংসতা মোকাবিলা ও প্রতিরোধে সহিংসতার শিকার নারী, তার পরিবার, স্থানীয় ব্যক্তিবর্গ, সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান, নীতিনির্ধারণী ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি
প্রত্যাশিত ফলাফল:
১. সহিংসতা মোকাবিলা এবং প্রতিরোধে ব্যক্তি নারী, পরিবার, স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বৃদ্ধি
২. সহিংসতার শিকার নারীর সহায়তায় স্থানীয় সংগঠনের ভূমিকা জোরদার
৩. বৈষম্যমূলক আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন ও সংশোধনের প্রস্তাবনা তৈরি
৪. সহিংসতার শিকার নারীর জন্য সরকারি সেবা এবং বিচার ব্যবস্থার দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি।
কৌশল:
১. নারীর উপর সহিংসতা প্রতিরোধে কর্মরত সরকারি, বেসরকারি সংগঠনের সাথে সংযোগ নির্মাণ, শক্তিশালী করা ও একযোগে কাজ করা
২. সহিংসতা কমিয়ে আনার জন্য নারীপক্ষ ও অন্যান্য সংগঠনের পদক্ষেপ ও উদ্যোগসমূহের নিবিড় পর্যালোচনা ও যথোপযুক্ত কার্যক্রম চিহ্নিতকরণ
৩. এ সংক্রান্ত দেশ-বিদেশের সমসাময়িক কার্যক্রম পর্যালোচনা, গবেষণা এবং অন্যান্য তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ
৪. সরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে যৌথভাবে কার্যক্রম গ্রহণ
৫. বিচার ব্যবস্থায় নারীর অভিগম্যতা সহজীকরণ, বিচারব্যবস্থার দায়বদ্ধকরণ এবং দুর্নীতি হ্রাসকরণ
৬. সহিংসতা দমন আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন ও সংশোধনের লক্ষ্যে দেনদরবার
৭. আন্দোলনে জনগণের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রচার-প্রচারণা শক্তিশালীকরণ
৮. যুদ্ধ ও সংঘাতকালীন যৌন সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ ও প্রতিকার নিশ্চিতকরণ
৯. সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে নারীর উপর সহিংসতা প্রতিরোধে যুক্ত করণ
১০. নারী-পুরুষের মধ্যে মর্যাদাপূর্ণ আচরণের চর্চা