Select Page
২০২৩-০২-০১
পোশাকে প্রাকৃতিক রং ব্যবহার করে দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্যে শোভিত করার অনন্য কারিগর, নারীপক্ষ’র প্রাক্তন সভানেত্রী রুবী গজনবী এর স্মরণে শ্রদ্ধা নিবেদন

১৮ মাঘ ১৪২৯/১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

নারীপক্ষ’র ৩৯ বছরের পথচলার সঙ্গী, প্রাক্তন সভানেত্রী, পরিবেশ আন্দোলনের পুরধা, ’৭১- এর ‘বীরাঙ্গনা’দের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং তাঁদের জীবনে অন্তত একটুখানি স্বচ্ছলতা ও প্রশান্তি দেয়ার লক্ষ্যে ‘৭১ এর যে নারীদের ভুলেছি’ কর্মসূচির অন্যতম সংগঠক রুবী গজনবী কোভিডোত্তর জটিলতার কারণে গত ১৪ জানুয়ারি ২০২৩, সন্ধ্যায় ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিলো ৮৮ বছর।

পোশাকে প্রাকৃতিক রং ব্যবহার করে দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্যে শোভিত করার অনন্য কারিগর ও একজন সফল প্রশিক্ষক হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত ছিলেন রুবী গজনবী। ফুল, লতা-পাতা, ফলের খোসা দিয়ে তিনি আবিষ্কার করেছিলেন প্রায় ৩০টি প্রধান রং। বিশ্বে প্রথম এবং বাংলাদেশে একমাত্র প্রাকৃতিক রংয়ে রঞ্জিত তাঁর প্রতিষ্ঠিত পোশাকের প্রতিষ্ঠান ‘অরণ্য ক্রাফ্ট’ দেশে-বিদেশে সমাদৃত। বাংলাদেশের ঐতিহ্য জামদানীশিল্পের প্রসারে রুবী গজনবীর অনেক গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ ছিলো। প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতেও তিনি ছিলেন অগ্রণী। তিনি তাঁর বিশাল কর্মযজ্ঞ ও অনন্য সৃষ্টিশীলতায় চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন আমাদের মাঝে।

রুবী গজনবী যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে বীরাঙ্গনাদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের জন্য প্রতিষ্ঠিত সেবাসদনের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। জীবনের দীর্ঘ সময় তিনি নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার কাজে ব্রতী ছিলেন। নারীর সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নারীপক্ষ’র সকল আন্দোলন ও কর্মসূচিতে তাঁর ছিলো বলিষ্ঠ ভূমিকা।

বহুমাত্রিক গুণের অধিকারিণী এই রুবী আপার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে এবং তাঁর সম্পর্কে অনুরাগী ও প্রিয়জনদের কথা জানতে ও জানাতে নারীপক্ষ’র আয়োজনে গতকাল ১৭ মাঘ ১৪২৯/৩১ জানুয়ারি ২০২৩, মঙ্গলবার নারীপক্ষ কার্যালয়ের নাসরীন হক সভাকক্ষে গানে, কথায়, চিত্রে অনুষ্ঠিত হয় স্মরণ অনুষ্ঠান “আছো বিটপীলতায়, জলদের গায়”- আমাদের রুবী আপা।

অনুষ্ঠানের শুরুতেই প্রয়াত রুবী গজনবীর প্রতি শ্্রদ্ধা জানিয়ে ১মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপর তাঁর জীবনের উল্লেখযোগ্য কর্মকান্ড নিয়ে নির্মিত একটি ভিডিওচিত্র- “আমাদের রুবী আপা” এবং তাঁর কন্যা ফারাহ গজনবীর উচ্চারণে আরো একটি ভিডিওচিত্র প্রদর্শন করা হয়। এরপর শিল্পী মহুয়া মঞ্জুরী সুনন্দার পরিবেশনায় “তুমি নির্মল করো, মঙ্গল করে …..” গানটি পরিবেশিত হয়।

অনুষ্ঠানে রুবী গজনবীর নানা দিক ও কর্মকান্ডের কথা উল্লেখ করে স্মৃতিচারণ করেন মেয়ে ফারাহ গজনবী, ছেলে জায়ান গজনবী এবং লুভা নাহিদ চৌধুরী, মানবাধিকার কর্মী হামিদা হোসেন, বন্ধু পারভীন হাসান, সহকর্মী ও ‘অরণ্য’ এর সদস্য শিরিন, টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির এর প্রতিষ্ঠাতা মনিরা ইমদাদ, উবিনীগ এর নির্বাহী পরিচালক ফরিদা আক্তার, বিশিষ্ট গবেষক ড. হালিদা হানুম, জামদানী তাঁতী কাশেম, সবুজ মিয়া, সজীব, ও শাহ আলম। আরো বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সদস্য এডভোকেট মাসুদা রেহানা রোজী ও কাজী সুফিয়া আক্তার শেলী এবং নারীপক্ষ’র সদস্য রীনা সেনগুপ্তা। এছাড়া ভিডিওবার্তা পাঠান মিতিয়া ও আনাদীল জনসন। তারা তাদের প্রিয়জন, আপনারজন, কাছের মানুষ রুবী গজনবীর কথা বলতে গিয়ে অনেকেই আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন। সৃষ্টি হয় এক আবেগঘন পরিবেশ।

বক্তারা বলেন, রুবী গজনবী সবক্ষেত্রেই একধরনের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জীবন কাটিয়েছেন। ২০১৯ সালে বালাদেশে জামদানী উৎসবের জন্য জাতীয় জাদুঘর না পাওয়ায় তিনি খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। তিনি খুব চাইতেন যে, ওয়াল্ড ক্রাফ্ট কাউন্সিলের কাছ থেকে জামদানীশিল্পটা একটা স্বীকৃতি পাক। এ নিয়ে তিনি সরকারের সাথে অনেক দেনদরবার করেছেন। অবশেষে বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী ডা. দিপুমনির সহযোগিতায় সেটি পেয়েছিলেন, যার ফলে ওয়ার্ল্ডক্রাফ্টস এ জামদানী জায়গা করে নিয়েছে। তিনি চেয়েছিলেন, বাংলাদেশেই প্রথম ওয়ার্ল্ডক্রাফ্ট কাউন্সিল হবে। তাঁর প্রচেষ্টায় বাংলাদেশে ১ম ওয়ার্ল্ডকাপক্রাফ্ট হয়।

রুবী গজনবী জামদানী তাঁতী ও কারুশিল্প কারিগরদের হাতে-কলমে কাজ শেখাতেন এবং তাদের রুজি-রোগার ও ব্যবসার উন্নতির জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করতেন। নিজে ডিজাইন দিতেন, রং নির্বাচন করতেন, তবে কারিগরদের মতামত ও পরামর্শকেও গুরুত্ব দিতেন, তাদের কাজের স্বাধীনতা দিতেন। জামদানী তাঁতী ও কারুশিল্প কারিগরদের জন্য তিনি প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করেছেন। তিনি ভারতসহ নানা দেশের হস্তশিল্প ও লোকশিল্পের অভিজ্ঞতাকেও কাজে লাগাতেন। বিভিন্ন যাদুঘরে ঘুরে ঘুরে জামদানীর নকশা সংগ্রহ করেছেন। তিনি বাংলাদেশের মৃতপ্রায় জামদানীশিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করেছেন। জামদানীশিল্পের অগ্রযাত্রায় তিনি ছিলেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁরই উদ্যোগ এবং চেষ্টায় দেশ-বিদেশে আজ বাংলাদেশের জামদানীর ঐতিহ্য ও মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত। তাঁর চলে যাওয়ায় জামদানী তাঁতীরা তাদের মাকে, অভিভাবককে হারিয়েছে।

ভেজিটেবল ডাই এখন যে এখন এতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে তার কৃতীত্বও রুবী গজনবীর।

রুবী গজনবী সারাজীবন নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে গেছেন। বাংলাদেশের কারুশিল্পী এবং নারীউদ্যোক্তারা তাঁরদ্বারা সর্বদা উপকৃত হয়েছেন। শিশুদের নিয়েও তাঁর ভাবনার অন্ত ছিলো না। শিশুশ্রমিকদের নিয়ে তিনি খুবই বিচলিত ছিলেন। তিনি বলতেন, শিশুশ্রমিকদের যদি রাখতেই হয় তাহলে যেন তাদের জন্য অন্তত ১ ঘন্টা খেলাধুলার সুযোগটুকু রাখা হয়। স্বল্প আয়ের মায়েদের জন্য স্থাপন করেছেন দিবাযতœ কেন্দ্র। গ্রামের দরিদ্র শিশু, অভিভাবকহীন শিশুদের জন্য অনেক কাজ করেছেন। পথশিশুদের আশ্রয়কেন্দ্রের ব্যবস্থা করেছেন।

রুবী গজনবী একজন অসাধারণ দক্ষ দৃষ্টিসম্পন্ন, পরিশ্রমী, উদ্যোগী, নির্ভরযোগ্য মানুষ ছিলেন। “আমাদের রুবী আপা আছেন আমাদের অন্তরে, থাকবেন সর্বদা নারী-আন্দোলনের পথচলায়।”

অনুষ্ঠানটি শেষ হয় শিল্পী মহুয়া মঞ্জুরী সুনন্দার পরিবেশনায় “মৃত্যু নয়, দুঃখ নয় …..” গানটির মধ্য দিয়ে।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন নারীপক্ষ’র আন্দোলন সম্পাদক তামান্না খান পপি। সম্পূর্ণ অনুষ্ঠানটি সরাসরি নারীপক্ষ’র ফেসবুক পাতায় প্রচারিত হয়।

বার্তা প্রেরক,

রেহানা সামদানী
প্রচার সম্পাদক, নারীপক্ষ।

Pin It on Pinterest

Share This