Select Page
২০২২-১২-১১
মুক্তিযুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের স্মরণে নারীপক্ষ’র শ্রদ্ধাঞ্জলি ‘আলোর স্মরণে কাটুক আঁধার’- ২০২২

গত ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪২৯/১১ ডিসেম্বর ২০২২ সন্ধ্যা ৫.২০ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মুক্তিযুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের স্মরণে নারীপক্ষ’র বিশেষ স্মরণ অনুষ্ঠান ‘আলোর স্মরণে কাটুক আঁধার’। ১৯৮৮ সাল থেকে প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসে বিজয় দিবসের প্রাক্কালে মুক্তিযুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের স্মরণে বিভিন্ন প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে নারীপক্ষ নিয়মিতভাবে “আলোর স্মরণে কাটুক আঁধার” অনুষ্ঠানটি উদযাপন করে আসছে। এবারের প্রতিপাদ্য “স্বাধীনতার ৫১ বছর: বীরাঙ্গনার অবহেলা-অপমান এবার হোক অবসান”।

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মুক্তিযুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের স্মরণ করে মোমবাতি জ্বালিয়ে স্বাধীনতার ৫১ বছরে বীরাঙ্গনাদের যে অবহেলা ও অপমান হয়েছে তার অবসানের দাবী জানাই।

এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে ‘আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রাণে’ গানের সাথে সাথে মুক্তিযুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের স্মরণে উপস্থিত সকলে একটি করে আলোর শিখা জ্বালিয়ে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। অনুষ্ঠানে ঘোষণাপত্র পাঠ করেন নারীপক্ষ’র সদস্য রেহানা সামদানী। গান পরিবেশন করেন সুরতীর্থ, লাকী, শ্রাবণী ও দিদার। কবিতা আবৃত্তি করেন ভাস্বর বন্দোপাধ্যায় ও শিখা সেন গুপ্তা। স্মৃতিচারণ করেন ডা. হালিদা হানম। তিনি তৎকালীন স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে ৩ নং ধানমন্ডিতে অবস্থিত সেবা সদনে বীরাঙ্গনাদের চিকিৎসা সেবা প্রদান করেছিলেন। তিনি জানান, ঐ সেবা সদনে ৩৫ জন বীরাঙ্গনাকে যে সেবদানের সুযোগ তিনি পেয়েছেন তা তাঁর জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ঐ সময়ে খুব কাছ থেকে বীরাঙ্গনাদের শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রনা অনুভব করতে পেরেছেন। তিনি আরো বলেন, এই বীরাঙ্গনাদের সম্ভ্রমের সাথে তাঁদের বাড়িঘর, পরিবার, নিশ্চিত ভবিষ্যৎ ও জীবন-সংসার সব হারিয়ে গেছে।
সবশেষে নারীপক্ষ প্রযোজিত ও দীপ্ত টেলিভিশন পরিচালিত বীরাঙ্গনা বিষয়ক তথ্যচিত্র ‘বীরাঙ্গনা আখ্যান’ প্রদর্শিত হয়। এই চিত্রে ময়মনসিংহের বীরাঙ্গনা জেলেখা খাতুন ও মৌলভীবাজারের বীরাঙ্গনা জয়গুন নাহার-এর জীবন অভিজ্ঞতা তুলে ধরা হয়।
নারীপক্ষ’র সদস্য রাশিদা হোসেন এর ধন্যবাদ জ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হয়।

 

ঘোষণাপত্র

নারীপক্ষ ১৯৮৮ সাল থেকে প্রতি বছর বিজয় দিবসের প্রাক্কালে মুক্তিযুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের স্মরণে “আলোর স্মরণে কাটুক আঁধার” অনুষ্ঠান আয়োজন করে আসছে। এবারের প্রতিপাদ্য “স্বাধীনতার ৫১ বছর: বীরাঙ্গনার অবহেলা-অপমান, এবার হোক অবসান।”

যাঁর উদ্যোগে নারীপক্ষ’র এই অনুষ্ঠানের সূচনা হয়েছিলো তিনি নারীপক্ষ’র প্রয়াত সদস্য নাসরীন হক। আজ আমরা তাঁকেও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। নারীপক্ষ’র আরেকজন সদস্য রুবী গজনবী, যিনি যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে বীরাঙ্গনাদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের জন্য প্রতিষ্ঠিত সেবা সদনের সাথে যুক্ত ছিলেন; তিনি এখন অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আমরা তাঁর সম্পূর্ণ আরোগ্য কামনা করছি।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এক উপেক্ষিত অধ্যায় হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন যৌন সহিংসতার শিকার নারী, যাদের সম্মান ও স্বাধিকার সমুন্নত রাখতে উপাধি দেয়া হয়েছিলো “বীরাঙ্গনা”। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন প্রায় পুরোটা সময় ধরে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের দ্বারা ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি নির্বিশেষে দেশের অসংখ্য নারী ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন। তাঁরা স্বাধীন বাংলাদেশে কেমন ছিলেন, কেমন আছেন? তাঁদের অনেকেই আজ আর বেঁচে নেই। আবার তাঁদের সবার খোঁজও আমরা জানি না। যাঁদের সম্পর্কে জেনেছি তাঁদের জীবন নিষ্ঠুরতা, নিগ্রহ, নিপীড়ন, অসম্মান ও অপমানে গাঁথা।

স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর ২০১৫ সালে সরকার বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তালিকা তৈরি করা শুরু করেছে। তালিকাভুক্ত বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধাদের মতো নিয়মিত মাসিক ২০ হাজার টাকা ও বিশেষ উৎসবভাতা দেয়া হচ্ছে। এর ফলে তাঁদের অর্থ কষ্টের যন্ত্রণায় কিছুটা স্বস্তি এসেছে। আমরা এজন্য সরকারকে সাধুবাদ জানাই। শুধুমাত্র আর্থিক সহযোগিতা নয়, তাঁদেরকে দেয়া “বীরাঙ্গনা” উপাধির যথাযোগ্য মর্যাদা ও সম্মান রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সেজন্য তাঁদের সামাজিক, মানসিক ও আর্থিক ক্ষতিপূরণার্থে পূর্ণ মর্যাদা প্রদান করার পক্ষে আমরা আমাদের দৃঢ় অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করছি। এই লক্ষ্যে ২০১১ সাল থেকে নারীপক্ষ তার সদস্য ও শুভানুধ্যায়ীদের অনুদানে ‘৭১ এর যে নারীদের ভুলেছি’ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এই কর্মসূচির আওতায় রয়েছে মাসিক ভাতা প্রদান, চিকিৎসা সহায়তা, শৌচাগারসহ বসতবাড়ি নির্মাণ ও তাঁদের জীবনগাথা সংরক্ষণ, ইত্যাদি। এই কর্মসূচির মাধ্যমে আমরা এযাবৎ যেসকল বীরাঙ্গনার সংস্পর্শে আসতে পেরেছি তাঁদের প্রত্যেকের জীবন কাটছে নানাবিধ সমস্যা-সঙ্কটে, রোগে-শোকে, দারিদ্রে, অপমানে, অবহেলায় এক নিদারুণ বঞ্চনা ও হতাশায়।

এখন পর্যন্ত সরকারি তালিকাভুক্ত হতে না পারা বীরাঙ্গনার সংখ্যাও অনেক। তদুপরি তালিকাভুক্তদের অনেকে নিয়মিত ভাতা প্রাপ্তিতে অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন। তাঁদের বয়স এবং নিরক্ষরতার কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যাংক থেকে অর্থ উত্তোলনের জন্য পরিবারের অন্য সদস্যদের উপর নির্ভর করতে হয় বিধায় অনেক সময়ই তাঁরা তাঁদের সম্পূর্ণ টাকা নিজের হাতে পান না।

“বীরাঙ্গনা” উপাধির যথাযোগ্য মর্যাদা ও সম্মান প্রতিষ্ঠা এবং তাঁদের জীবন ও জীবিকার উন্নতি নিশ্চিত করতে করণীয়:
* অতি দ্রæততার সাথে সহজ পদ্ধতিতে নিরপেক্ষভাবে সকল বীরাঙ্গনাকে সরকারের তালিকাভুক্ত করে তাঁদের সচ্ছল জীবন যাপনের উপযুক্ত পরিমাণ মাসিক ভাতা নিয়মিতভাবে দেয়া
* তাঁদের বসবাসের উপযোগী বাসস্থান ও শৌচাগারের ব্যবস্থা করা
* বীরাঙ্গনাদের জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরকারিভাবে সম্পূর্ণ বিনা খরচে নিশ্চিত করা
* জাতীয় পাঠ্যক্রমে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ বীরাঙ্গনাদের বিষয়টি যুক্ত করা
* রাষ্ট্রীয় দলিল-দস্তাবেজ থেকে বীরাঙ্গনাদের প্রতি অসম্মানজনক শব্দ-বাক্য, যেমন: “দুই লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে …”- বাতিল করা এবং সরকারি-বেসরকারি সকল পর্যায়ের অনুষ্ঠান ও কর্মসূচিতে বক্তৃতা বা ভাষণে এই ধরনের বাক্য বা ভাষা ও শব্দ ব্যবহার বন্ধের নির্দেশ দেয়া
* স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবসের মতো জাতীয় উদ্যাপন কর্মসূচিতে বীরাঙ্গনাদের যুক্ত করে সম্মানিত করা
* বীরাঙ্গনাদের কথা, গল্প ও জীবন অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করে রাখা, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এই দিকটি সম্পর্কে জানতে ও বুঝতে পারে
* জাতীয় পর্যায়ের গণমাধ্যমে বীরাঙ্গনাদের কথা গুরুত্বসহকারে প্রকাশ করা
* স্থানীয় এলাকায় বীরাঙ্গনাদের নামে স্মৃতিসৌধ/সড়ক/পার্কের নামকরণ করা এবং প্রতিটি জেলায় একটি করে ‘বীরাঙ্গনা মঞ্চ’ তৈরি করা
* স্বাধীনতার ৫১ বছরেও সকল বীরাঙ্গনার সম্মানজনক জীবন ও জীবিকা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হওয়ার দায় স্বীকার করে সরকার কর্তৃক জনসমক্ষে দুঃখ প্রকাশ করা।

আজ এখানে মুক্তিযুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের স্মরণে প্রজ্জ্বলিত এই আলো আমাদের মন থেকে সকল অন্ধকার, কুপমন্ডুকতা ও সঙ্কীর্ণতা দূর করুক। অবসান হোক বীরাঙ্গনার অবহেলা, অপমান। বন্ধ হোক ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার শিকার নারীকে দোষারোপ, অসম্মান, অপমান, ও অপদস্থ করার চর্চা। আমরা চাই আমাদের বীরাঙ্গনা বোনেরাসহ প্রতিটি মানুষ সম-মর্যাদা, সম্মান এবং শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক নিরাপত্তায় বসবাস করবে।

দিনক্ষণ: ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪২৯/১১ ডিসেম্বর ২০২২, রবিবার বিকাল ৫:২০ থেকে সন্ধ্যা ৬:৩০ মিনিট
স্থান: কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার
নারীপক্ষ

Pin It on Pinterest

Share This