২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১/০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, শুক্রবার সন্ধ্যা ৫.২০মিনিটে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মুক্তিযুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া স্বজন এবং জুলাই-আগষ্ট ২০২৪ এ স্বৈরাচারী সরকারের পতনে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহতদের স্মরণে নারীপক্ষ’র বিশেষ স্মরণ অনুষ্ঠান ‘আলোর স্মরণে কাটুক আঁধার’ অনুষ্ঠিত হল। ১৯৮৮ সাল থেকে প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসে বিজয় দিবসের প্রাক্কালে মুক্তিযুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের স্মরণে বিভিন্ন প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে নারীপক্ষ নিয়মিতভাবে “আলোর স্মরণে কাটুক আঁধার” অনুষ্ঠানটি উদ্যাপন করে আসছে। এবারের প্রতিপাদ্য “সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদার বাংলাদেশ কতদূর?”
সমতা, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার পাওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সূচনা হয়েছিলো। স্বাধীনতা পরবর্তীতে এই রাষ্ট্রেটিতে বহু পট পরিবর্তন ও একের পর এক শাসক বদল হয়েছে। স্বাধীনতার ৫৩ বছরে দাঁড়িয়েও আমাদের ভাবতে হচ্ছে, বাংলাদেশটা কি আজও সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদার বাংলাদেশ হয়ে উঠতে পেরেছে! মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বলীয়ান হয়ে সকল অসমতা দূর করে একটি অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক মর্যাদার বাংলাদেশ গড়ে তোলার অঙ্গীকার করবে।
এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে ‘আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রাণে’ গানের সাথে সাথে মুক্তিযুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া স্বজন এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহতদের স্মরণে উপস্থিত সকলে একটি করে আলোর শিখা জ্বালিয়ে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। অনুষ্ঠানে ঘোষণাপত্র পাঠ করেন নারীপক্ষ’র সদস্য রেহানা সামদানী। গান পরিবেশন করেন- জলতরঙ্গের শিল্পীবৃন্দ। কবিতা আবৃত্তি করেন ইকবাল আহমেদ ও ডা: সালমা শবনম। স্মৃতিচারণ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ফরহাদ মাহমুদ, সেকটর ২ ও ৩ তিনি বলেন, এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী সুফিয়া আকতার।
নারীপক্ষ’র সদস্য ফেরদৌসী আখতার এর ধন্যবাদ জ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হয়।
ঘোষণাপত্র
নারীপক্ষ ১৯৮৮ সাল থেকে প্রতিবছর বিজয় দিবসকে কেন্দ্র করে মুক্তিযুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের স্মরণে একেকটি প্রতিপাদ্য নিয়ে “আলোর স্মরণে কাটুক আঁধার” অনুষ্ঠান আয়োজন করে আসছে। এবারের প্রতিপাদ্য “সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদার বাংলাদেশ কতদূর?”
সমতা, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার পাওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সূচনা হয়েছিলো। স্বাধীনতা পরবর্তীতে এই রাষ্ট্রে বহু পট পরিবর্তন ও শাসক বদল হয়েছে। স্বাধীনতার ৫৩ বছরে দাঁড়িয়েও আমাদের ভাবতে হচ্ছে, বাংলাদেশটা কি আজও সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদার বাংলাদেশ হয়ে উঠতে পেরেছে?
বাংলাদেশ রাষ্ট্র যাত্রা শুরুর মাত্র কয়েক বছরের মাথায়ই দেশ পরিচালনার লিখিত দলিল সংবিধানের মূল নীতি থেকে সরে আসে। চালু করা হয় একদলীয় সরকার ব্যবস্থা। মানুষের রাজনৈতিক ও স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকারের উপর নেমে আসে চরম আঘাত। পরবর্তীতে রাজনৈতিক হত্যাকান্ড, অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থান এবং জেলহত্যার মতো ঘটনাধারার মধ্য দিয়ে একের পর এক সেনাশাসক ক্ষমতায় আসেন। তাদেরই একজন দ্বারা সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার চার মূলনীতির একটি ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে বিলুপ্ত করে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক ধারাকে উৎসাহিত করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় আর এক সেনাশাসক দ্বারা সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা হয়, ফলে রাষ্ট্রীয়ভাবে জনগণকে ধর্মীয় বৈষম্যের মধ্যে ফেলে দিয়ে মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি ও আবেগ নিয়ে এক ঘৃণ্য রাজনৈতিক খেলার প্রবর্তন হয়! সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে সংসদীয় ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তনের ফলে জনগণ তাদের ভোটাধিকার ফিরে পান কিন্তু পরবর্তী শাসনামলে অচীরেই আবার জনগণ স্বাধীনভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগে প্রচন্ড বাধার সম্মুখীন হন। এভাবেই একটি একতরফা সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দল রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থান দীর্ঘস্থায়ী করতে স্বৈরাচারী ও কর্তৃত্ববাদী কায়দায় দেশ শাসন করতে থাকে। কার্যত আবারও গণতন্ত্রের মৃত্যু ঘটে। সর্বতোভাবে অবরুদ্ধ হয় মানুষের স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার। “ভোটার বিহীন” বা “দিনের ভোট রাতে” অথবা “আমি-ডামি”র জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন দলের প্রবল আধিপত্য ও দুর্নীতি-দুঃশাসনে সমতা, সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানুষ হিসেবে মর্যাদা পাবার আকাংক্ষা ভূলুণ্ঠিত হয়।
২০২৪- এর জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অপ্রতিরোধ্য আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সংঘটিত রক্তক্ষয়ী গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশেও আমরা স্বস্তিতে নেই। প্রতিহিংসার রাজনীতি অব্যাহতভাবে চলছে। সাধারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বিধান এখনও হয়নি। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিও নিয়ন্ত্রণে আসেনি। ন্যায়বিচার এখনও প্রশ্নবিদ্ধ। বাজার সিন্ডিকেট ভাঙা যায়নি। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে স্বল্প আয়ের মানুষ দিশেহারা। নানাবিধ ধর্মীয় উস্কানিতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় মানুষ। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, “সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদার বাংলাদেশ কতদূর?”
আমাদের আকাক্সক্ষা: কেবল ব্যক্তি ও সরকার বদল নয়, গণতন্ত্রহীনতা এবং স্বৈরাচারী, কর্তৃত্ববাদী ও বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার চির অবসান ঘটিয়ে “সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদার বাংলাদেশ” প্রতিষ্ঠা।
আমাদের আহবান,
* রাজনৈতিক দলসমূহ সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করুন, সমতা ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনে ইতিবাচক রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নে কার্যকর ভূমিকা রাখুন
* সর্বস্তরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনির্মান ও তা বজায় রাখতে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় নেতৃত্বের ভূমিকা নিন
* ধর্ম-বর্ণ-জাতি-গোষ্ঠীগত সংখ্যালঘিষ্ঠরা নিজের নাগরিক অধিকার ভোগ করতে কারো কাছে দয়া বা করুণা ভিক্ষা নয়; ভয়-ভীতি, বিভ্রান্তি কাটিয়ে দেশের মাটিতেই শক্তিশালী অবস্থান নিন। দেশ গঠনে স্বাধীন নাগরিক দায়িত্ব পালন করুন, সাহসী ভূমিকা রাখুন
* বিগত সময়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠান থাকার সুযোগে যারা বৈধ-অবৈধভাবে কেবল নিজেদের হীন স্বার্থ হাসিল করেছেন ও বিপুল অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছেন তারাও আর কালবিলম্ব না করে দেশের স্বার্থ রক্ষায় নিজেদের সময়, শ্রম ও অর্থ-সম্পদ বিনিয়োগ করুন, গঠনমূলক উদ্যোগ নিন, ভূমিকা রাখুন।
সরকারের কাছে আমাদের দাবি,
* ’২৪ এর গণ-অভ্যুত্থানের সুফল দেশের প্রতিটি নাগরিকের কাছে পৌঁছানোর উপায় নির্ধারণ করুন
* দেশ গঠনে সর্বস্তরের জনগণের, বিশেষকরে রাজনৈতিক দলসমূহের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ এবং ক্ষেত্রমতো তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে মতামত ও সহযোগিতা নিন
* জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দিয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার কাজগুলো দ্রæততার সাথে সম্পন্ন করুন।
আর নয় প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা, হানাহানি, বিদ্বেষ; আসুন, মুক্তিযুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের স্মরণে আজ আমরা এখানে যে মোমবাতির আলো জ্বেলেছি সেই আলোয়ে নিজেদের আলোকিত করি; সকল প্রকার শোষণ, বৈষম্য, নিপীড়ন দূর করে গড়ে তুলি “সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদার বাংলাদেশ।”
দিন-ক্ষণ: ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১/৬ ডিসেম্বর ২০২৪, শুক্রবার বিকাল ৫:২০ থেকে সন্ধ্যা ৬:৩০ মিনিট
স্থান: কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার