ঘোষণাপত্র
বিশ্বব্যাপী নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে উদ্যাপিত হয়ে আসছে ‘বিশ্ব নারীদিবস’। বাংলাদেশে সরকার, নারী সংগঠন ও মানবাধিকার সংগঠন ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নারীদিবস উদ্যাপন করে। বিশ্বের সকল যুদ্ধে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার প্রত্যেক নারীর স্মরণে ”যুদ্ধ ও সংঘাতময় পরিস্থিতিতে নারীর ওপর যৌন আক্রমণ ও ধর্ষণ” বিষয়ে নারীপক্ষ’র এবছরের আয়োজন ‘কালের যাত্রায় ভুলেছি যাদের’।
১৮৫৭ সালে নিউ ইয়র্কের সেলাই কারখানাগুলোতে নারী শ্রমিকরা বিপদজনক ও অমানবিক কর্মপরিবেশ, স্বল্প মজুরী এবং দৈনিক ১২ ঘন্টা শ্রমের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ মিছিল বের করলে তা পুলিশী হামলার সম্মুখীন হয়। তিন বছর পরে তারা নিজস্ব ইউনিয়ন গঠনে সমর্থ হয়। নারীদের বিভিন্নমুখি প্রতিবাদী ভূমিকার প্রতি আমত্মর্জাতিক সংহতি প্রকাশ, সমর্থন দান ও সহযোগিতার ক্ষেত্র তৈরীর প্রতীক হিসেবে একটি দিন চিহ্নিত করার উপলব্ধি জাগে। অত:পর ১৯১০ সালে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেন শহরে দ্বিতীয় আমত্মর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক নারী সম্মেলনে জার্মান সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী ক্লারা জেটকিনের প্রসত্মাবে ৮ই মার্চকে ‘বিশ্ব নারীদিবস’ ঘোষণা করা হয়।
নারী আন্দোলনের এই প্রতিবাদী ধারাকে সমুন্নত রেখে ১৯৮৮ সাল থেকে নারীপক্ষ ৮ই মার্চ উদ্যাপন করছে। ১৯৯১ সালে নারীপক্ষ’র উদ্যোগে ৪৬টি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হয় আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদ্যাপন কমিটি এবং এরপর থেকে এই কমিটি বিভিন্ন প্রতিপাদ্য বিষয়কে নিয়ে নানা কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে দিবসটি উদ্যাপন করে।
যুদ্ধ মানেই ধ্বংসযজ্ঞ, নৃসংশতা, রক্তপাত, মৃত্যু বা মৃত্যু আতঙ্ক, হত্যা-প্রতিহত্যা, ধর্ষণ-যৌন নির্যাতনসহ বিভীষিকাময় অনিশ্চয়তা। যারা সরাসরি যুদ্ধরত তারা এগুলো জেনে-বুঝে ও মেনে নিয়েই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরে কিন্তু নিরস্ত্র জনতা এসবের শিকার হয় মাত্র। এরমধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় নারী ও শিশু।
প্রায় প্রতিটি যুদ্ধ বা সশস্ত্র সংঘাতে নারীর ওপরে সংঘটিত হয় ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন, যার যন্ত্রণা ও বিড়ম্বনা সারা জীবন ধরে ঐ নারীকে বয়ে বেড়াতে হয়। দুইটি বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি, রাশিয়া, চীন ও আর্মেনিয়ার বন্দি নারীদের ওপর জাপানি সৈন্যদের ভয়ঙ্কর যৌন নির্যাতন এবং পরবর্তীতে ভিয়েতনামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবহিনীর বর্বরতার কথা আমরা জানি। সম্প্রতি কোরিয়ার কমফোর্ট নারীদের ওপর ১৯৩২ থেকে ১৯৪৫ জাপানি সামরিক বাহিনীর যৌনদাসত্বের বিষয়টির প্রতি বিশ্বসমাজ ধিক্কার জানিয়েছে। হেগ এ অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে জাপানি সেনাবাহিনী কর্তৃক কোরিয়া, তাইওয়ান, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন ও এর আশপাশের অঞ্চলের অসংখ্য নারীকে যৌন দাসত্বের শৃঙ্ক্ষলে আবদ্ধ করার সত্যতা প্রমাণিত।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাক-হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসর কর্তৃক অসংখ্য নারী ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছেন। স্বাধীনতার পর তাঁদেরকে সইতে হয়েছে বাড়তি অপমান এবং সামাজিক-পারিবারিক তাচ্ছিল্য, বিদ্রুপ ও অবহেলা। পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও সমাজ তাঁদের ফিরিয়ে নিতে অস্বীকার করলে আত্নপরিচয় ও আশ্রয় বা আবাসন সংকট তঁদেরকে আর একটি বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে। উদ্বেগ, উৎকন্ঠা, শঙ্কা, আশ্রয়হীনতা, নিরাপত্তার অভাব এবং অন্ন,বস্ত্র-চিকিৎসা, মর্যাদার সংকট- সব মিলিয়ে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে তাঁরা চল্লিশটি বছর কাটিয়েছেন। স্বাধীনতার পরে তৎকালীন সরকার নারী পূনর্বাসন কর্মসূচীর অধীনে তাঁদের জন্য ঢাকা ও সিরাজগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন। এইসব আশ্রয়কেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেলে সরকারী তরফের সামান্য আশ্রয়টুকুও তাঁরা হারান।
রাষ্ট্রীয় অবহেলায়, রাজনৈতিকদল ও সুধীসমাজের মনোযোগের বাইরে, এমনকি পরিবার ও আপনজনদের কাছ থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে তাঁরা বাধ্য হয়েছেন। যাঁরা এখনও বেঁচে আছেন তাঁদের অনেকে চরম অর্থসঙ্কট, শারীরিক অসুস্থতাসহ নানা সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে দিনাতিপাত করছেন, অনেকে অন্যের বাড়ীতে কাজ করে বা ভিক্ষা করে অন্ন যোগাচ্ছেন।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিসত্মানী হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর কর্তৃক ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার নারীদের সম্মান ও মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখতে স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁদের ‘‘বীরাঙ্গনা’’ উপাধি দিয়েছিলেন। ‘বীরাঙ্গনা’ অর্থ বীরযোদ্ধা, বীরনারী, বীর্যবতী বা সাহসীনারী। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে বীরাঙ্গনা শব্দের অর্থ এবং ব্যবহার সম্পূর্ণ বিপরীত। আমাদের সমাজ-সংস্কৃতির চিরাচরিত দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী যৌন নির্যাতন নারীর ইজ্জত বা সম্ভ্রম হানি ঘটায়। পরিবার ও সমাজ তাকে অপমান ও অপধস্ত করে এবং তাকেই অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে। ’৭১- এর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার নারীদের বেলায়ও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। এই চিরাচরিত নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণ প্রতিহত করতে তাঁদের প্রতি প্রকাশ্য সম্মান দেওয়া বা কোনও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, ফলে এই উপাধি তাঁদের জন্য অসম্মান, অপমান, অপবাদ এবং লাঞ্ছনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। স্বাধীনতা পরবর্তী চল্লিশ বছরে তাঁরা ‘বীরাঙ্গনা’ এর সম্মান, মর্যাদা এবং জীবন যাপনের ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা কিছুই পাননি, এমন কি তাঁদের ওপর সংঘটিত অপরাধের বিচারও হয়নি।
সরকারী-সেরকারী সকল পর্যায়ে ‘৭১- এ যৌন নির্যাতনের শিকার নারীদের প্রতি অমর্যাদাকর উক্তি, ভাষা ও শব্দ ব্যবহার চলমান, যেমন ”দুই লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন ”, ইজ্জত হানি, সম্ভ্রম হানি, ধর্ষিতা, ইত্যাদি শব্দ-বাক্য। কিন্তু এই সম্ভ্রম বা ইজ্জত কার? কে হারিয়েছে সম্ভ্রম? কে-ই বা হারিয়েছে ইজ্জত? ”ইজ্জত ” বা ”সম্ভ্যম ” কোন অবস্থায়ই নির্যাতনের শিকার ব্যক্তির শরীর কেন্দ্রিক হতে পারে না। ‘৭১- এ মুক্তিযুদ্ধ চলা কালে নারীদের ওপর যে যৌন নির্যাতন হয়েছে তা কোন সাধারণ অপরাধ নয়, তা যুদ্ধ অপরাধ। এই অপরাধ সংঘটনকারী ও এতে সহায়তা দানকারীদের বিচার হওয়া জরুরী।
আমরা ‘৭১- এ যৌন সহিংসতার শিকার নারীদের প্রতি অমর্যাদাকর উক্তি, ভাষা ও শব্দ ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে সকলের প্রতি আহবান জানাচ্ছি এবং সকল সরকারী দলিল ও কার্যক্রম থেকে ”মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে”/ ”মা-বোনের সম্ভ্রম হানি” ধরনের উক্তির স্থলে সরাসরি ‘‘১৯৭১- এর স্বাধীনতা যুদ্ধে দুই লাক্ষ নারী ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন’ এই বাক্য প্রতিস্থাপন করার দাবি করছি।
বীরাঙ্গনাদের নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে কিছু গবেষণাকর্ম এবং কয়েকটি নাটক-উপন্যাস রচনা ছাড়া প্রায় সকলের অগোচরে থেকে গেছে তাঁদের কঠিন জীবন সংগ্রামের কাহিনী। মাঝে মাঝে কয়েকটি টিভি চ্যানেল ও বেসরকারী সংগঠন বিশেষ বিশেষ দিনে সভা-সমাবেশে বা ক্যামেরার সামনে তাঁদেরকে জন-সমক্ষে নিয়ে এসেছে। ব্যক্তিগতভাবে কেউ কেউ এবং দু’একটি বেসরকারী সংগঠনও বীরাঙ্গনাদের জন্য অর্থ সাহায্য করেছেন কিন্তু আজ অবধি বীরাঙ্গনাদের জন্য সরকারী কোন ভাতার ব্যবস্থা করা হয়নি।
দেরীতে হলেও আমরা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার নারীদের পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়েছি। আমরা চাই, রাষ্ট্র ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধির মূল্যায়ন করে তাঁদের সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করবে এবং তাঁদের জন্য আর্থিক স্বচ্ছলতার সাথে জীবন যাপনের ব্যবস্থা করবে, যাতে সকল প্রতিবন্ধকতা ভেঙে তাঁরা পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, সর্বত্র মর্যাদার সাথে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেন।
‘বীরাঙ্গনা’র সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের অংশ হিসেবে আমাদের আজকের নিবেদন ”কালের যাত্রায় যাদের ভুলেছি”
আমাদের দাবি :
’৭১- এর মুক্তিযুদ্ধে নারীর ওপরে সংঘটিত ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন কোন সাধারণ অপরাধ নয়, তা যুদ্ধ অপরাধ। এই অপরাধ সংঘটনকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিচার
বীরাঙ্গনাদের প্রতি সরকারী-বেসরকারী সকল পর্যায়ে লিখনে, বলনে বা ভাষণে শব্দ ও ভাষা ব্যবহারে ধর্ষিতা, ইজ্জতহানি, সম্ভ্রমহানি, ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। সকল রাষ্ঠ্রীয় দলিল ও কার্যক্রম থেকে ”দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে …” বা ”দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি …” ধরনের কথা বাতিল করে সে স্থানে সরাসরি ”১৯৭১- এর মুক্তিযুদ্ধে দুই লাখ নারী ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন’ এই বাক্য ব্যবহার করতে হবে
‘৭১- এ বীরাঙ্গনাদের জন্য সরকারী সহায়তা, যথা সকল সরকারী হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা এবং ভাতা প্রদান করতে হবে যাতে তাঁরা স্বাচ্ছন্দে জীবনযাপন, সম্মান ও মর্যাদার সাথে তাঁদের পছন্দমতো স্থানে বসবাস করতে পারেন।
নারীপক্ষ
নীলু স্কোয়ার (৫ম তলা), সড়ক- ৫/এ, বাড়ী- ৭৫, সাতমসজিদ রোড, ধানমন্ডি, ঢাকা-১২০৯, বাংলাদেশ।
জিপিও বক্স-৭২৩, ঢাকা-১০০০, ফোন : ৮৮০-২-৮১১৯৯১৭, ৮১৫৩৯৬৭, ফ্যাক্স : ৮৮০-২-৮১১৬১৪৮
ই-মেইল : naripokkho@gmail.com, ওয়েব : www.naripokkho.org.bd