ঘোষণাপত্র
ধর্ম নিয়ে রাজনীতি চলবে না
৮ মার্চ। সারা বিশ্বে নারী সমাজের অধিকার প্রতিষ্ঠায় দিনটি মাইলফলক। ১৮৫৭ সালে এই দিনে নিউইয়র্কের একটি সেলাই কারখানায় নারী শ্রমিকরা অমানবিক ও বিপজ্জনক কর্ম পরিবেশে, দৈনিক বারো ঘন্টা কাজ ও স্বল্প মজুরির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও আন্দোলন শুরু করে। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন নারী অধিকার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯১০ সালে জার্মান নারী নেত্রী ক্লারা জেটকিনের প্রসত্মাব অনুসারে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তখন থেকেই সারা বিশ্বে দিবসটি বিশেষ গুরুত্বের সাথে পালিত হয়ে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯১ সাল থেকে বাংলাদেশেও ৪৮টি মানবাধিকার ও উন্নয়ন সংগঠন সমন্বয়ে গঠিত আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন কমিটি প্রতি বছর দেশের নারী সমাজের বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে একটি বিশেষ বিষয়কে প্রতিপাদ্য করে দিনটি উদযাপন করে আসছে।
১৯৯১ সালে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন করার জন্য যে কমিটি গঠন করা হয়েছিল, এর মূল সংগঠক ছিলেন প্রয়াত নাসরিন হক। ধর্ম নিয়ে রাজনীতি নিষিদ্ধ করার জন্য তাঁর কণ্ঠ ছিল সোচ্চার ও প্রতিবাদী। গত ৮ ডিসেম্বর ২০০৫ সালে নেত্রকোণায় সন্ত্রাসী বোমা হামলায় চার জন সংস্কৃতি কমীর্র প্রাণহানি ঘটেছিল। ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়লে সারা দেশে এক ভয়াবহ পরিবেশ সৃষ্টি হয় এবং সেই দিনই সেই ভীতিকর পরিবেশের মধ্যেও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আলোর স্মরণে কাটুক আধার অনুষ্ঠানের পর নাসরীন হক মঞ্চ থেকে শ্লোগান দিয়েছিলেন ধর্ম নিয়ে রাজনীতি চলবে না। আজ ‘ধর্ম নিয়ে রাজনীতি চলবে না’ বিষয়কে ভিত্তি করে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করতে গিয়ে তাঁকে সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করছি।
সম্প্রতি রাজনীতিতে ধর্মকে সম্পৃক্ত করার প্রবণতা ও দেশের নারী সমাজের দীর্ঘ সংগ্রামের ফসলকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
ধর্ম নিয়ে রাজনীতি আমাদের স্বাধীনতা চেতনার পরিপন্থি, সামাজিক মননশীলতা ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার পরিপন্থি এবং নারী স্বাধীনতা ও অধিকার পরিপন্থি। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের মানুষ অংশগ্রহণ করেছে, হারিয়েছে আপনজন। আর এ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সাংবিধানিক মূলনীতির একটি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বিভিন্ন সময়ের সরকার ধর্ম নিরপেক্ষতাকে বিসর্জন দিয়ে হীন স্বার্থে ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করেছে। আমরা বিশ্বাস করি ধর্ম যার যার কিন্তু রাষ্ট্র সবার। ধর্মকে রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কিত করা কোন মুক্ত বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের কাজ নয়।
সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেয়া হয় এবং ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। সকল বিরোধিতা, প্রতিবাদ, প্রতিরোধকে উপেক্ষা করে রাজনৈতিক দলগুলো ধর্ম নিয়ে রাজনীতির খেলায় মত্ত হয়। ধর্মের অজুহাতে রাজনৈতিক দলগুলো নারীকে সম অধিকার থেকে বঞ্চিত করে চলেছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এবং নির্বাচনী কৌশল হিসেবে ফতোয়াবাজ এবং ধর্মান্ধ রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে জোটবদ্ধ হওয়া এবং চুক্তি সম্পাদনের ঘটনাও ঘটেছে। এভাবে সুদীর্ঘ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগ্রামের মাধ্যমে যে স্বাধীন বাংলাদেশ আমরা পেয়েছিলাম তাকেই আজ রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রম প্রশ্নবোধক করে তুলছে। একই সাথে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ও কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর ধর্ম ব্যবহার যাতে জ্ঞান ও সংস্কৃতি চর্চা ও জীবন-জীবিকার সংগ্রামে সংগ্রামরত নারীর পদক্ষেপকে বাধাগ্রস্ত ও সংকুচিত করতে না পারে- সে জন্য প্রয়োজন সচেতন সংগঠিত সামাজিক সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও আইন সংস্কার।
রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকতে পারে না, ধর্ম মানুষের। তাই রাষ্ট্রকে হতে হবে ধর্মনিরপেক্ষ। ধর্ম একটি ব্যক্তিগত বিষয়। এ বিষয়ে রাষ্ট্রীয় হসত্মক্ষেপ কাম্য নয়। তাই আমাদের শ্লোগান ‘যার ধর্ম তার কাছে রাষ্ট্রের কি বলার আছে’।
আমাদের দাবি
• বাংলাদেশকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সংবিধানের সংশ্লিষ্ট সংশোধনী বাতিল করা।
• বিভিন্ন ধর্ম ও প্রথা ভিত্তিক পারিবারিক আইন বাতিল করে সকল নাগরিকের জন্য নারী পুরুষের মধ্যে সমতাভিত্তিক সর্বজনীন আইন প্রনয়ন করা।
আমাদের করণীয়
সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে এবং প্রতিষ্ঠানে ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে সকল নাগরিকের সমমর্যাদা নিশ্চিত করা।
আমাদের আহবান
জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে যে মূল্যবোধের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ হয়েছিল, সর্বক্ষেত্রে সেই মূল্যবোধের চর্চা করুন।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদ্যাপন কমিটি
নারীপক্ষ
র্যাংগস নীলু স্কোয়ার (৫ম তলা), সড়ক- ৫/এ, বাড়ী- ৭৫, সাতমসজিদ রোড, ধানমন্ডি, ঢাকা-১২০৯, বাংলাদেশ।
জিপিও বক্স-৭২৩, ঢাকা-১০০০, ফোন : ৮৮০-২-৮১১৯৯১৭, ৮১৫৩৯৬৭, ফ্যাক্স : ৮৮০-২-৮১১৬১৪৮
ই-মেইল : naripokkho@gmail.com, ওয়েব : www.naripokkho.org.bd