Select Page
১৯৯৮-০৩-০৮
আন্তর্জাতিক নারী দিবস ১৯৯৮

স্বাধীনভাবে পথ চলবো, নিজের কথা নিজে বলবো

৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এই দিনটির তাৎপর্য বুঝতে হলে আমাদের যেতে হবে। ১৮৫৭ সালে, নিউ ইয়র্কের সেলাই কারখানাগুলোতে। এই দিনে সেখানে নারী শ্রমিকরা, পিবদজনক ও অমানবিক কর্মপরিবেশ, স্বল্প মজুরী এবং দৈনিক ১২ ঘন্টা শ্রমের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ মিছিল বের করলে তা পুলিশী হামলার সম্মখীন হয়। তিন বছর পরে তারা নিজস্ব ইউনিয়ন গঠনে সমর্থ হয়। নারীদের বিভিন্নমুখী প্রতিবাদী ভূমিকার প্রতি আন্তর্জাতিক সংহতি প্রকাশ, সমর্থন দান ও সহযোগিতার ক্ষেত্র তৈরীর প্রতীক হিসেবে একটি দিনকে চিহ্নিত করার উপলব্ধি জাগে। অত:পর ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনগেগেন শহরে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক নারী সম্মেলনে, জার্মান সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী ক্লারা জেটকিনের প্রস্তাবে ৮ই মার্চকে বিশ্ব নারী দিবস ঘোষণা করা হয়।

নারী আন্দোলনের এই প্রতিবাদী ধারাকে তুলে ধরে দিনটি পালনের লক্ষ্যে ১৯৯১ সনে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদ্যাপন কমিটি গঠিত হয়। বিগত ৭ বছর ধরে এই দিবস উদ্যাপনের মধ্যে দিয়ে আমরা নারী আন্দোলনের বিভিন্ন দাবী তুলে ধরেছি। এবারের আন্তর্জাতিক নারী দবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘নারীর স্বাধীন চলাফেরার অধিকার’।

স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে স্বাধীন চলাফেরা আমাদের জন্মগত অধিকার হওয়া সত্তে¡ও এ অধিকার থেকে আমাদেরকে বঞ্চিত করা হয় সুকৌশলে। শিশুকাল থেকে নারীকে বলা হয় বাইরে যাওয়া নিরাপদ নয়। পরবর্তীতে স্বামী-সন্তান, সংসারের বোঝা বেঁধে ফেলে বন্ধ করে দেয় স্বাধীন চলার পথ। এভাবে পরিবার ও সমাজে নারীর চলাচলকে সংকুচিত করে দেয়। নারী বাধ্য হয় এই শৃঙ্খল মেনে নিতে এবং অভ্যস্ত হয়ে পড়ে ক্ষুদ্রপরিসরে জীবনযাপনে।

সংসারের মৌলিক চাহিদা পূরণের তাগিদে সংসারের বাইরে নারীর শ্রম বিক্রয় প্রয়োজন হলেও, সংসার সন্তানের সমস্ত কাজ সঠিকভাবে পালনের পরই তাকে ঘরের বাইরের কাজ নিতে হয় বাড়তি দায়িত্ব হিসেবে। নারীর নিজের অবসর অবকাশ পালনের সুযোগ অতি সীমিত। গৃহস্থালী কাজকর্ম ও সন্তান পালনে পুরুষের অংশগ্রহণ বাড়ানো এবং নারীর অবসর ও অবকাশ নিশ্চিত করা, নারীর স্বাধীন চলাফেরার পূর্বশর্ত।

শত সহস্র বাধার পাহাড় ডিঙ্গিয়ে গৃহের পরিচিত পরিবেশের বাইরে পা ফেলেও নারী নিশ্চিত মনে ভোগ করতে পারে না স্বাধীন চলাফেরার অধিকার। রিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয় পথে ঘাটে কর্মস্থলে সর্বত্র-পুরুষের অশ্লীল টিটকারি, ইশারা, ধাক্কা, গয়ে হাত, এমন কি অযাচিত প্রেম অথবা বিয়ের প্রস্তাব। এর প্রতিবাদ কিংবা প্রস্তাব প্রত্যাখান নারীর জীবনে বয়ে আনতে পারে অপহরণ, এসিড নিক্ষেপ, ধর্ষণ বা হত্যার হুমকি। অহরহ ঘটে যাওয়া এ ঘরনের ঘটনা নারী ও তার পরিবারকে আরো শঙ্কিত করে। ফলে আরো সংকুচিত হয় নারীর বিশ্ব।

এ তো হলো ঘরের বাইরে নিরপত্তাহীনতার কথা। কিন্তু ঘরেও বা নারী কতটা নিরাপদ? কতটা স্বাধীনভাবে চলতে পারে? সারা বিশ্বেই নারী তার নিজ গৃহে নির্যাতিত হচ্ছে। নির্যাতনের প্রতিবাদ করার জায়গা, সুযোগ, ক্ষমতা-কোনটাই নেই বা থাকলেও অতি-সীমিত। নির্যাতনের বলয় থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সাহায্য সহায়তাও বিরল।

প্রতিবন্ধী নারীরা এই নির্যাতনের অধিকতর শিকার। নির্যাতন, দুর্ঘটনা কিংবা জন্মগত কারণে যারা প্রতিবন্ধী হয়ে যান, দৃষ্টি শক্তি হারান কিংবা ঝলসে যাওযা মুখাবয়ব নিয়ে সমাজে বাস করেন, তারা চলা ফেরায় সম্পূর্ণ পরাধীন হয়ে থাকেন। তাদের স্বাধীনভাবে চলার কথা কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারে না। পথে ঘাটে লোক-জন তাদের দেখে ব্যঙ্গ করে, আবার এসিড ঝলসানো মুকের বিৃতি দেখে আঁতকে উঠে। সরকারী কাঠামোয় সমাজ কল্যাণের জন্য একটি দপ্তর থাকলেও, বিষয়টিকে দেখা হয় শুধুমাত্র করুণার দৃষ্টিতে। প্রতিবন্ধী নারীর চলার অীধকার প্রতিষ্ঠায় রাস্তাঘাট, পার্ক, দালান, যানবাহন সমূহে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার কোন রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নেই।

এ সত্ত্বেও নারী এগিয়ে চলছে
* কোন সিড়ি বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না হুইল চেয়ারের সামনে
* বর্হিজগতের অনিশ্চয়তা উপেক্ষা করে নারীরা ছুটছে দূর দূরান্তরে বিভিন্ন প্রয়োজনে, কাজের সন্ধানে
* সামাজিক বাঁধা ডিঙ্গিয়ে বেরিয়ে আসছে নারীরা দিনে-রাতে, ঘর থেকে বাইরে, গ্রাম থেকে শহরে, দেশে-বিদেশে

চারিদেকে বাধাঁ বেরিয়ে আসার পদক্ষেপ শুরু হয়েছে। এই পদধ্বনি পৃথিবীব্যাপী। সমস্ত পৃথিবীতে আজ নারী তার মুক্তি ঘোষণা করেছে। এই মুক্তি দেহের, এই মুক্তি চিন্তার, এই মুক্তি স্বাধীনভাবে চলার। বিশ্ব নারী দিবস আমাদের সংগ্রামের ইতিহাস স্মরণ করার দিন। সেই সংগ্রামকে সামনে এগিয়ে নেবার সংকল্পে আমাদের উদযাপনে অংশগ্রহণ করার জন্য আপনাদের আমন্ত্রণ রইল। এবার বিশ্ব নারী গিদবস উপলক্ষ্যে আমাদের ঘোষণা, স্বাধীনভাবে পথ চলব, নিজের কথা নিজে বলব।

Pin It on Pinterest

Share This