৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এই দিনটিক আমরা ঐতিহসিকভাবে যুক্ত করে থাকি বিশ্বব্যাপী নারী অধিকার আন্দোলনের বিভিন্ন সংগ্রামী অধ্যায়ের সাথে। ১৮৫৭ সালে ৮ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরে সেলাই কারখানার নারী শ্রমিকরা বিপদজনক ও অমানবিক কর্ম পরিবেশ, স্বল্প মজুরী ও দৈনিক ১২ ঘন্টা শ্রমের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ মিছিল বের করে। তাদের সেই শান্তিপূর্ণ মিছিলের উপর পুলিশ হামলা চালায়। তিন বছর পর ১৮৬০ সালের ৮ মার্চে নিউ ইয়র্ক শহরের সেলাই কারখানার নারী শ্রমিকরা সংঘবদ্ধ হয়ে তাদের দাবী আদায়ের লক্ষ্যে নিজস্ব ইউনিয়ন গঠনে সমর্থ হয়। নারী আন্দোলনের উত্তরোত্তর বিস্তৃতির ফলশ্রুতিতে ১৮৯৯ সালে নেদারল্যান্ডস-এর দি হেগ শহরে প্রথম যুদ্ধ বিরোধী নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯০৫ থেকে ১৯০৭ সালে রাশিয়ার রাজতন্ত্র বিরোধী সংগ্রামে অসংখ্য নারী সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। পরবর্তীতে ১৯০৮ সালের ৮ই মার্চে নিউ ইয়র্কে একটি প্রতিবাদ মিছিলে বস্ত্রশিল্প কারখানার নারী শ্রমিকরা আবারও যোগ দেন। তাদের দাবী ছিল কাজের সময় কমানো, কাজের পরিবেশের উন্নতি, শিশু শ্রমের বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন এবং ভোটাধিকার।
এই সকল ঘটনা ধারার সম্মিলনের মধ্যে দিয়েই নারীদের বিভিন্নমুখী প্রতিবাদী ভূমিকার প্রতি আন্তর্জাতিক সংহতি প্রকাশ, সমর্থন দান ও সহযোগিতার ক্ষেত্র তৈরির প্রতীক হিসেবে একটি দিনকে চিহ্নিত করার উপলব্ধি জাগে। অতঃপর ১৯১০ সালে কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত তৃতীয় আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক নারী সম্মেলনে জার্মান সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী ক্লারা জেটকিনের প্রস্তাব অনুসারে ঐতিহাসিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ তারিখ হিসেবে ৮ই মার্চকে বিশ্ব নারী দিবস ঘোষণা করা হয়।
বাংলাদেশে এই দিনটি ব্যাপক ভাবে পালনের লক্ষ্যে বিভিন্ন সংগঠনের সমন্বয়ে ১৯৯১ সনে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন কমিটি গঠিত হয়। প্রতি বছর আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন করা হয় সমাজে নারী অবস্থা ও অবস্থানের একটি বিশেষ দিক এবং সেই দিকগুলির সাথে সংম্লিষ্ট দাবী তুলে ধরে। সর্বস্তরে, সর্বক্ষেত্রে নারী পুুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আইন সংস্কারের দাবীই ছিল ১৯৯১ সনের নারী দিবস কর্মসূচীর মূল বিষয়বস্তু। নারীর প্রতি সব ধরনের নির্যাতন, অত্যাচার ও অপরাধকে মানবাধিকার লংঘন হিসেবে স্বীকৃত করার লক্ষ্যে উদযাপিত হয় ১৯৯২ সনের আন্তর্জাতিক নারী দিবস। ১৯৯৩ সনে আমাদের দাবী ছিল বিচার ব্যবস্থার আমূল সংস্কার। এ বছর আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপনের মূল বিষয় বস্তু “নারীর শরীরের উপর নারীর অধিকার স্থাপন”। এই দাবী নারী অধিকার আন্দোলনের একটি মৌলিক দাবী।
নারীর শরীরেই তৈরি হয় মান সন্তান, নারীর এই উৎপাদন ক্ষমতাই নারী পরিচিতির এক মূল বৈশিষ্ট্য। এই উৎপাদনই নিশ্চিত করছে মানব সমাজের ধারাবাহিকতা। অথচ সন্তান নেয়া না নেয়ার সিদ্ধান্ত, সন্তানের অভিভাবকত্বের অধিকার কোনটাই তার নাই।
মানব সমাজের ক্রমবিকারে জন্য অপরিহার্য নারীর এই ক্ষমতাকে উত্তরাধিকার প্রশ্নে করা হয় কুক্ষিগত। নিশ্চিত পিতৃপরিচয়ের প্রয়োজনে নিয়ন্ত্রণের স্বীকার হয় নারী ও নারীর শরীর। তার অন্য সকল পরিচয়ের সম্ভাবনাকে বাদ দিয়ে মাতৃত্বকে মহিমান্বিত করার মাধ্যমে সন্তান ধারনের ক্ষমতা পরিণত হয়েছে প্রতিবন্ধকতায়। মাতৃত্বের অজুহাতে নারীকে করা হয়েছে গৃহবন্দী। অপরদিকে সন্তান ধারনে অক্ষম বা অনিচ্ছুক নারী নিগৃহীত হয় পরিবারে ও সমাজে, আবার কখনো হয় গৃহচ্যুত। মানুষের সমস্ত মৌলিক পরিচিতিকে ম্লান করে আজ নারী শুধুমাত্র “মা”।
নারী ও নারীর শরীর নিয়ন্ত্রণের আর এক দিকে নারীর স্বাধীন চলাচলকে সীমাবদ্ধ করা। এই সকল সীমাবদ্ধতা হয়ত বা স্থান ও শ্রেণী বিশেষে কম বেশী। তবে সীমানার কঠিন বলয় প্রতিটি নারীর চারপাশ ঘিরে রেখেছে। এ বলয় অতিক্রম করতে গেলে নারীকে হতে হয় সমালোচনার ও হয়রানীর সম্মুখীন, হতে হয় আক্রমণের স্বীকার। নারীর চারপাশের এই নিয়ন্ত্রণ নারীর দেহ এবং মনকে করে রেখেছে সংকুচিত।
নারীর প্রজনন ক্ষমতা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে পরিবারের প্রয়োজনে, নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে। সারা বিশ্বে এটি অত্যন্ত সুস্পষ্ট যে, যে- সকল দেশে জনসংখ্যা কম সে-সকল দেশের নারীদের বার বার মা হওয়ার জন্য কখনো প্রলুবদ্ধ, কখনো বাধ্য করা হয়। অন্যদিকে যে সকল দেশে জনসংখ্যার আধিক্য রয়েছে বলে রাষ্ট্র মনে করে, সেখানে নারীর উপর বর্তায় জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব। আর নারীর শরীরের উপর চাপানো হয় নানা প্রকার জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির উপকরণ। অথচ এ ব্যাপারে একক সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার পর্যন্ত তার নেই। গর্ভপাত বা বন্ধ্যাকরণ উভয় ক্ষেত্রেই প্রয়োজন হয় স্বামীর অনুমতি।
সমাজ সংস্কৃতির দৃষ্টিতে ‘মানুষ নারীর’ চেয়ে নারীর শরীরই মূখ্য। শিল্পে সাহিত্যে নারীর দেহ, নারীর রূপ, যৌবনই প্রধান উপাদান। অথচ নারীর দৈহিক শ্রমের স্বীকৃতি বা সঠিক মূল্যায়ন কোথাও নেই। মুক্তবাজার সস্তা শ্রমের প্রয়োজনে ব্যবহার করছে নারীর শ্রমকে। তারপরও শ্রমবাজারে নারীর শ্রমের সুযোগের ব্যাপ্তি বা প্রসার সীমিত। এই সীমানা নির্ধারিত হয় নারীর জন্য কোনটি সঠিক, কোনটি সঠিক নয় সেই সামাজিক সংজ্ঞা দ্বারা সমান যোগ্যতা থাকা সত্তে¡ও অনেক কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রবেশ বাধাপ্রাপ্ত। অন্যদিকে প্রথাগতভাবে উৎপাদনে সরাসরি অংশগ্রহণ করেও স্বীকৃতি পায় না। যেমন একজন নারী কৃষি কাজে পঞ্চাশভাগ কাজ করেও কৃষকের মর্যাদা পায় না। অনুরূপভাবে একজন নারী গৃহে তার সমস্ত ত্যাগ ও শ্রম দিয়ে নির্মাণ করে তার পারিবারিক আবাস। তথাপি পরিবারেও সুদৃঢ় হয় না তার স্থান, মূল্য পায় না তার শ্রম।
নারীর শরীরকে ঘিরে নারীকে কোণঠাসা করে রাখার সামাজিক প্রক্রিয়ার অপরদিকে রয়েছে নারী মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস।
সমস্ত পৃথিবীতে নারী তার মুক্তি ঘোষণা করেছে। সে মুক্তি দেহের, সে মুক্তি চিন্তার, সে মুক্তি স্বাধীনভাবে বাঁচার। বিশ্ব নারী দিবস আমাদের সেই ইতিহাসকে স্মরণ করার দিন। সেই সংগ্রামকে সামনে এগিয়ে নেবার সংকল্পে আমাদের উদযাপন, আমাদের উৎসব। আমাদের এই উদযাপনে অংশগ্রহণ করার জন্য আপনাদের আমন্ত্রণ রইল। এবার বিশ্ব নারী দিবসে আমাদের ঘোষণা “শরীর আমার সিদ্ধান্ত আমার, শরীর আমার অধিকার আমার।”