উদ্যমে উত্তরণে শতকোটি’ অভিযানের উদ্যোগে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ পালন
আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে আজ ২৪ ফাল্গুন ১৪১৯/৮ মার্চ ২০১৩ শুক্রবার ‘উদ্যমে উত্তরণে শতকোটি’ অভিযানের উদ্যোগে দিবসটি পালন করা হয়েছে ‘‘রাতের বেড়া ভাঙবো, স্বাধীনভাবে চলবো’’ এই প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে। কর্মসূচীর মধ্যে ছিলো: বিকাল ৫.৩০ একটি মশাল মিছিল আসাদ গেট থেকে শুরু হয়ে ধানমন্ডি সাতমসজিদ সড়ক এর ৫/এ এসে শেষ হয়। মিছিলে ‘উদ্যমে উত্তরণে শতকোটি’ অভিযানের প্রায় ৫০০ নারী পুরুষ অংশগ্রহণ করে। মশাল মিছিল শেষে ধানমন্ডি ৫/এ (সাতমসজিদ) সড়ক এর র্যাং গস নীলু স্কয়ার ভবনের সামনে সংক্ষিপ্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে কর্মসূচীর সমাপ্তি হয়। অনুষ্ঠানে ঘোষণা পাঠ, কবিতা আবৃত্তি, নারীকে উত্তক্তকরণ বিষয়ক অভিজ্ঞতা ভিত্তিক নাটিকা, অভিনয় ও দলীয় নাচ পরিবেশন করা হয়।
ঘোষণাপত্র
আজ ৮ মার্চ, ‘বিশ্ব নারীদিবস’। ১৮৫৭ সালে ৮ই মার্চ নিউ ইয়র্কের সেলাই কারখানায় বিপদজনক ও অমানবিক কর্মপরিবেশ, স্বল্প মজুরী এবং দৈনিক ১২ ঘণ্টা শ্রমের বিরুদ্ধে নারী শ্রমিকরা প্রতিবাদ করে। এরপর বিভিন্ন সময়ে ৮ই মার্চে উল্লেখযোগ্য আরো ঘটনার ধারাবাহিকতায় ১৯১০ সালে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক নারী সম্মেলনে জার্মান সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী ক্লারা জেটকিন এর প্রস্তাবে ৮ই মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক নারীদিবস’ ঘোষণা করা হয়।
প্রতি বছরের মতো এ বছরও বিশ্বব্যাপী নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে উদ্যাপিত হচ্ছে ‘বিশ্ব নারীদিবস’। বাংলাদেশে ‘উদ্যমে উত্তরণে শতকোটি’ অভিযানের উদ্যোগে আজ আমরা দিবসটি পালন করছি “রাতের বেড়া ভাঙবো, স্বাধীনভাবে চলবো” এই প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে।
পরিবার থেকে রাষ্ট্র অবধি নারী কোথাও নিরাপদ নয়। ঘরে, ঘরের বাইরে, রাস্তাঘাটে, যানবাহনে, কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সর্বত্রই নারী নিরাপত্তাহীন ও সহিংসতার ঝুঁকির মধ্যে। জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের জরিপমতে, নারীর উপর ধর্ষণ, হত্যা, এসিড আক্রমণ, পাচার, পারিবারিক নির্যাতন ও বাল্যবিবাহ- সহিংসতার ঘটনায় বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ স্থানে রয়েছে। দেশে ধর্ম, বর্ণ, বয়স নির্বিশেষে সকল নারী ঝুকির মধ্যে, তন্মধ্যে আদিবাসী ও প্রান্তিক নারীর উপর নির্যাতনের ঝুঁকি অনেকগুণ বেশী। বাংলাদেশ পুলিশ সদরদপ্তর এর সূত্র অনুযায়ী, ২০০১-২০১২ পর্যন্ত নারীর উপর সহিংসতার মামলা হয়েছে মোট ১,৮৪,৪২২টি। শুধুমাত্র ২০১২ সালে ১৯,৬১৭টি সহিংসতার মামলা হয়েছে। বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায়, স্বামী ও তার পরিবারের নিকটজনদের দ্বারা ঘরে ঘরে সংঘটিত হয় অসংখ্য নির্যাতনের ঘটনা যা নিয়ে সাধারণত কোন মামলা হয় না। জোরপূর্বক ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর উপায়ে গর্ভপাতের কারণে বহু নারীর অস্বাভাবিক মৃত্যুর পিছনেও রয়েছে নির্যাতন ও নিপীড়নের অসংখ্য জানা-অজানা ঘটনা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সূত্রমতে, এই ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভপাতের কারণে সারা বিশ্বে প্রতি বছর ২ কোটি ১৬ লক্ষ নারী প্রাণ হারায়।
স্বাধীন জীবন যাপন এবং জীবিকার লক্ষ্যে ঘরের চার দেয়ালের বাইরে নারীর বিচরণ আবশ্যক; তথাপি নিশ্চিত হয়নি নারীর জন্য নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও স্বাধীন পথ চলা। প্রতিনিয়ত পথে-ঘাটে নারীকে উত্যক্তকরণ এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়। এমনকি চলন্ত বাসে ও ট্রেনে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনাও ঘটছে। নারী নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে আধুনিক প্রযুক্তিও ব্যবহৃত হচ্ছে নানাভাবে, নানা কায়দায়।
দেশের অর্থনীতির সিংহভাগ যোগান দিচ্ছে পোশাক শিল্পে কর্মরত হাজার হাজার নারী শ্রমিক। সেই নারী শ্রমিককে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে, বঞ্চিত করা হচ্ছে তাদের ন্যায্য মজুরী থেকে। তাজরীনসহ আরো কয়েকটি পোশাক কারখানায় শত শত নারী কর্মীর আগুনে পুড়ে মৃত্যু তার একটি নির্মম উদাহরণ। যে নারীদের শ্রমে দেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরছে তাদের জীবনের নিরাপত্তার জন্য মালিকপক্ষ ও সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সকলে নির্বিকার। অতি লাভের লোভ, দুর্নীতি, অনিয়ম ও শ্রমিককে ন্যায্য মজুরী থেকে বঞ্চিত করে সম্পদের পাহাড় গড়ার নেশায় তারা এতটাই মত্ত যে, তালাবদ্ধ করে আগুনে পুড়িয়ে কারখানার প্রাণ সেই শ্রমিক হত্যা অতি তুচ্ছ ব্যাপার। এর জন্য দোষীদের বিরুদ্ধে সত্যিকার অর্থে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয় না, জবাবদিহি করতে হয় না; কখনো কখনো কেবল তথাকথিত ক্ষতিপূরণের নামে কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে সামাল দেয়া হয় মাত্র।
সীমাহীন দুর্নীতি, জবাবদিহিতার অভাব এবং নারীর অধিকার ও মর্যাদার প্রতি অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার জন্য সরকারী অথবা বেসরকারী কোন কার্যক্রম বা উদ্যোগ আজ পর্যন্ত সন্তোষজনক কোন প্রতিকারের নজীর স্থাপন করতে পারেনি। তথাপি নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে দেশের সরকারী ও বেসরকারী সকল কার্যক্রমকে সাধুবাদ জানাই ও তাদের সাথে একযোগে কাজ করার অঙ্গিকার জানাই। যেসকল ব্যক্তি সাহসের সাথে নির্যাতনের শিকার নারীর পাশে দাড়ান আমরা তাদের জানাই আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।
নারীদের উপর এই সকল ঝুঁকি সম্পর্কে আমাদের অবশ্যই সাবধান হতে হবে, অন্ধকারাচ্ছন্ন পুরুষ-শাসিত সমাজ ব্যবস্থা, ধর্মীয় কুসংস্কারের বেড়াজাল ছেদ করে বেড়িয়ে আসতে হবে আলোকিত জীবনে। আমরা ভীত হব না, অবদমিত হব না, বরং নিজের স্বাধীন চলাফেরার অধিকার প্রতিষ্ঠার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে যাবো। আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে আমরা আবারও সেই অঙ্গীকার ব্যক্ত করছি। স্বোচ্চার কণ্ঠে আওয়াজ তুলছি “রাতের বেড়া ভাঙবো, স্বাধীনভাবে চলবো।”