বয়ঃসন্ধিকালঃ
বয়ঃসন্ধিকাল জীবনের একটি সময় যখন ছেলে-মেয়ে উভয়ের দেহ এবং প্রজনন অঙ্গ দ্রুত বাড়াতে শুরু করে ও পূর্ণতা পায়। বয়ঃসন্ধিকাল সাধারণত মেয়েদের ১০-১৯ বৎসরের মধ্যে সম্পন্ন হয় এবং ছেলেদের ১১-২০ বৎসরের মধ্যে সম্পন্ন হয়। আমাদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে অনেক গ্রন্থি আছে, এই সকল গ্রন্থি থেকে বিভিন্ন ধরনের রস বের হয় যাকে হরমোন বলে।
হরমোন শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে প্রভাব বিস্তার করে এবং শরীরের বিভিন্ন কাজ সম্পাদনে সহায়তা করে, যেমন- এস্ট্রোজেন অধিক পরিমাণে নিঃসৃত হলে মেয়েদের “মেয়েলী” পরিবর্তন ঘটে। তেমনি ছেলেদের শরীরে অধিক পরিমাণে টেস্টসটেরোন নিঃসৃত হলে ছেলেদের “পুরুষালি” পরিবর্তন ঘটে। শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ও পুষ্টি, বংশগত ধারা ও পরিবেশের কারণে বিভিন্ন জনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময় এই হরমোন নিঃসরণের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় যার ফলে বয়ঃসন্ধিকাল একেক জনের ক্ষেত্রে একেক সময় শুরু হয়। ডাক্তারী পরীক্ষার মাধ্যমে এই সব হরমোন পরিমাপ করা যায় এবং কৃত্রিম উপায়ে দেহের হরমোন বাড়ানো কিংবা কমানো যায়, যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর। সে কারণে ষ্টেরয়ড ট্যাবলেট গ্রহণ করা একেবারেই উচিত না, কারণ তা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
বয়ঃসন্ধিকালের পরিবর্তন দেহের, মনের ও আবেগের যা স্বাভাবিক। বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেমেয়েদের দেহের স্বাভাবিক পরিবর্তন হলে শরীরের উচ্চতা, ওজন, হাড়, মাংসপেশী এবং শক্তি বৃদ্ধি ঘটে। সেজন্য এ সময়ে বাড়তি খাবার প্রয়োজন। প্রজনন সংক্রান্ত পরিবর্তনগুলি হচ্ছে মেয়েদের বগলে ও যৌনাঙ্গে লোম উঠে, স্তনে চর্বি জমা ও গঠনের পরিবর্তন, যৌনাঙ্গের আকার বৃদ্ধি, তলপেটের মধ্যে ডিম্বাশয়ে ডিম ফুটে মাসিক শুরু অর্থাৎ দৈহিকভাবে গর্ভধারণে সক্ষম হয়। ছেলেদের দাড়ি মোচ গজায়, বুকে, বগলে, যৌনাঙ্গে লোম উঠে, কণ্ঠস্বর পরিবর্তন হয়, যৌনাঙ্গের আকার বৃদ্ধি, শুক্রকীট তৈরী ও বীর্যপাত অর্থাৎ প্রজনন সক্ষম হয়।
বয়ঃসন্ধিকালে মন ও আবেগের পরিবর্তন ঘটে, মানসিক অস্থিরতা ও আবেগ প্রবণতা বৃদ্ধি পায়, এটাই স্বাভাবিক। প্রেম, ভালবাসা ও যৌনতা সম্পর্কে ছেলে-মেয়ে উভয়ের কৌতুহল জাগে। এই আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে শিখতে হয় যাতে আমরা কখনও অন্যের অধিকার লংঘন না করি।
হরমোনের প্রভাবে যেমন শরীর, মন ও আবেগের পরিবর্তন ঘটে তেমনি মুখে ব্রণ দেখা দেয়। ব্রনের নিঃশ্চিত কোন প্রতিকার নেই। এ ব্যাপারে যত্ন নিতে হলে যে বিষয়গুলি খেয়াল রাখতে হবে: মুখ যেন তৈলাক্ত না থাকে তার ব্যবস্থা করা, তৈলাক্ত বা তেলে ভাজা খাবার না খাওয়া, প্রতিদিন প্রচুর পানি ও জলীয় খাবার খাওয়া। মানসিক চাপের কারণেও ব্রণ হতে পারে।
বয়ঃসন্ধিকালে মেয়েদের বিশেষ ভাবে খেয়াল রাখা প্রয়োজনঃ
মাসিক : মেয়েদের তলপেটে জরায়ু থাকে। জরায়ুর দুপাশে ২টি ডিম্বাশয় এবং ২টি ডিম্ববাহী নালী থাকে। হরমোনের প্রভাবে সাধারণত যেকোন ১টি ডিম্বাশয় থেকে প্রতি মাসে ১টি ডিম্বাণু পাকে এবং ফুটে বের হয়। ডিম্বাণু পাকা ও ফোটার সময়ে হরমোনের প্রভাবে জরায়ুর ভিতরের গায়ে অনেক পর্দা তৈরী হয়। এদিকে ডিম্বাণু পেকে, ডিম্বাশয় থেকে বের হয়ে ডিম্ববাহী নালীর মধ্যে চলে আসে এবং পুরুষের শুক্রাণুর জন্য ২৪ ঘন্টা অপেক্ষা করে। ডিম্বাণু ও শুক্রাণু মিলিত হলে গর্ভধারণ এবং ২৮০ দিন পরে একটি সন্তান জন্ম হয়। ২৪ ঘন্টার মধ্যে শুক্রাণু এসে মিলিত না হলে ডিম্বাণু মরে যায় এবং আস্তে আস্তে হরমোন নিঃসরণ কমে যায় ফলে জরায়ুর ভিতরের পর্দাগুলি ভাঙ্গতে থাকে, যা রক্তের সাথে যোনিপথ দিয়ে বার হয়ে যায় এটাকেই মাসিক বলে।
ডিম ফোটা এবং মাসিক একটা সময়ের ব্যবধানে হয়ে থাকে, যাকে ঋতুচক্র বলে। সাধারণত ঋতুচক্র ২৮ দিন বা এর কম বা বেশী দিনে হতে পারে। মাসিক যেদিন শুরু হয় সেদিন ঋতুচক্রের ১ম দিন ধরা হয় এবং ১২-১৫ দিনের মধ্যে (সাধারণতঃ ১৪ দিনে) ডিম সম্পূর্ণ পাকে এবং ডিম্বাশয় থেকে বের হয়। ডিম্বাণু ও শুক্রাণু মিলিত না হলে হরমোন নিঃসরণ করতে থাকে এবং ১২দিনের সময় হরমোন একেবারে কমে গেলে মাসিক আবার শুরু হয় এবং পরবর্তী নতুন ঋতুচক্র সূচনা হয়।
মাসিকের সময় জরায়ুর ভিতরের পর্দা ছেড়ার জন্য জরায়ু সংকুচিত হয় ফলে জরায়ুতে চাপ পরে এবং সে কারণে তলপেটে ব্যাথা হয়। জরায়ুর ভেতরের পর্দা পুরুণ হলে মাসিকের রক্ত বেশী যায় এবং পাতলা হলে মাসিকের রক্ত কম যায়। এই কম বেশি কোন রোগ নয়। তবে অতিরিক্ত রক্তস্রাব হয়ে যদি রক্তশূন্যতা দেখা দেয় তাহলে জরুরী ভিত্তিতে ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিৎ।
আমাদের দেশে মাসিক সংক্রান্ত প্রচুর কুসংস্কার আছে। অনেকের ধারণা মাসিকের রক্ত দূষিত। তাই যে মেয়ের মাসিক হয়েছে তাকে অপরিষ্কার মনে করা হয়। কিন্তু আসলে মাসিকের রক্ত দূষিত না। শরীর থেকে রক্ত ঝরে গেলে তা দ্রুত জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং দুর্গন্ধ ছড়ায়। মাসিকের সময় পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকলে এবং ঘন ঘন মাসিকের কাপড় পাল্টালে দুর্গন্ধ হয় না। মাসিকের কাপড় সব সময় ভালো করে ধুয়ে কড়া রোদে শুকাতে হয়। তাহলে কাপড়ের মাধ্যমে রোগ জীবাণু যোনিপথে প্রবেশ করে না। মাসিক শেষ হলে সব কাপড় এক সাথে সাবান, সোডা, গরম পানিতে ফুটিয়ে, ধুয়ে, শুকিয়ে, ভাজ করে, পরিস্কার জায়গায় রাখতে হবে যাতে করে পরের মাসে প্রয়োজন মতো ব্যবহার করা যায়। এভাবে মাসিকের সময় পরিষ্কার না থাকলে যোনিপথে, জরায়ুতে ও প্রস্রাবে বিভিন্ন ধরনের প্রদাহ হতে পারে। প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে পানি খেলে প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া কম হয়।
বয়ঃসন্ধিকালে হরমোনের প্রভাবে প্রজনন অংঙ্গের গ্রন্থিগুলো থেকে বিভিন্ন রস নিঃসরণ হয় যাকে সাদাস্রাব বলে এবং যা স্বাভাবিক কিন্তু পরিস্কার পরিচ্ছন্ন না থাকার জন্য রোগ জীবাণু হলে, সাদাস্রাব অতিরিক্ত হয়, তলপেটে ব্যথা হয়, যোনিপথ চুলকায়, প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া হয়।
বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেদের জন্য বিশেষভাবে খেয়াল রাখা প্রয়োজন:
বয়ঃসন্ধিকালে হরমোনের প্রভাবে ছেলেদের প্রজনন অঙ্গ ও বিভিন্ন গ্রন্থি থেকে রস নিঃসৃত হয়। এই সকল রস ও শুক্রাণুকে বীর্ষ বলে। শুক্রাশয়ে বীর্য তৈরী হয়ে পুরুষ প্রজনন নালীতে জমতে থাকে। যখন বেশী পরিমাণে জমা হয় তখন এই তরল পদার্থ নিজে থেকে বের হয়ে আসে। বেশীর ভাগ সময়ে রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় বেরিয়ে আসে। সাধারণ ভাষায় এটাকে স্বপ্নদোষ বললেও এটা কোন দোষের নয়। এটা স্বাভাবিক শারীরিক প্রক্রিয়ামাত্র। এই তরল বীর্ষ রসই যৌন সঙ্গমের সময়ে বা হস্তমৈথুনের সময় বের হয়ে আসে।
বয়ঃসন্ধিকালে মন ও আবেগের পরিবর্তনের ফলে ছেলেমেয়েরা একে-অপরের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ফলে অনেক সময় ছেলেরা মেয়েদের প্রতি বিভিন্ন মন্তব্য করে এবং তাদেরকে উত্যক্ত করে। পরস্পরের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক না থাকার কারণে ভুল বুঝাবুঝি হয় এবং জোরপূর্বক ভালোবাসা প্রকাশ করে। যা সকলের জন্য অস্বস্তিকার। এই বিষয়ে ছেলেদেরকে মেয়েদের মানসিকতা বুঝতে হবে এবং সেরকম আচরণ করতে হবে যেন মেয়েদের অধিকার খর্ব না হয়।
প্রেম ভালোবানসার বাইরে মেলেমেয়েদের বন্ধুত্ব হতে পারে। তার জন্য প্রয়োজন পরস্বপরের প্রতি সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব। এ ধরনের বন্ধুত্ব ছেলেমেয়েদের মধ্যে সুস্থ ও সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তোলে। এর ভিত্তিতেই গড়ে উঠবে নারী ও পুরুষের মধ্যে বন্ধুত্ব এবং সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব। নারী ও পুরুষ তখন একে অপরকে মানুষ হিসেবে নিচতে শিখবে এবং সমাজে নারী পুরুষ সম্পর্কে বিরাজমান বৈষম্য দূর করার একটা প্রক্রিয়া শুরু হবে।
বয়ঃসন্ধি সময় যৌনতা সম্পর্কে কৌতুহল, যৌন বিষয়ক আলাপ ছেলেমেয়েদের মধ্যে যৌনসংসর্গের ইচ্ছা সৃষ্টি করে, কিন্তু ১৮ বছরের আগে পর্যন্ত শরীর পরিপক্ক হয় না এবং মানসিক পরিপক্কতাও হয় না। অথচ এ বিষয়ে কৌতুহল থাকে, মনে প্রশ্ন জাগে যা সামাজিকতার কারণে কাউকে জিজ্ঞাসা করা যায় না। সেজন্য অনেক সময় কাল্পনিক উত্তর খোঁজা হয়। এ বিষয়ে সঠিক বৈজ্ঞানিক তথ্য দিতে পারে, এমন ব্যক্তিকে খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই এই বয়সে ছেলেমেয়েদের প্রচুর ভ্রান্ত ধারণা রয়ে যায়। আমরা সেজন্য এই প্রচারপত্রে কিছু তথ্য পরিবেশন করেছি।