Select Page
১৯৯১-০৩-০৮
আন্তর্জাতিক নারী দিবস- ১৯৯১

প্রতি বছর ৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপিত হয়ে থাকে। বিশ্বব্যাপী নারী অধিকার আন্দোলনের বহুমুখী সংগ্রামী অধ্যায়ের সাথে এই দিনটি ঐতিহাসিকভাবে যুক্ত। ১৮৫৭ সালের ৮ই মার্চে নিউ ইয়র্ক শহরের সেলাই কারখানার নারী শ্রমিকদের শান্তিপূর্ণ মিছিলের উপর পুলিশের আক্রমণ চলে। সেই দিন বিপজ্জনক ও অমানবিক কর্মপরিবেশ, স্বল্প মজুরী ও দৈনিক ১২ ঘন্টা শ্রমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল নারী শ্রমিকরা। এই ঘটনার পরিণতিতে নিউ-ইয়র্ক শহরের গার্মেন্টস কারখানার নারী শ্রমিকরা সংঘবদ্ধ হন। নারী আন্দোলনের উত্তরোত্তর বিস্তৃতির ফলশ্র“তিতে ১৮৭১ সালে নেদারল্যান্ডস-এর ডেন হাগে প্রথম যুদ্ধ বিরোধী নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, ১৯০৫ থেকে ১৯০৭ সালে রাশিয়ায় রাজতন্ত্র বিরোধী সংগ্রামে অসংখ্য নারী সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। পরবর্তীতে ১৯০৮ সালে ৮ ই মার্চে নিউ-ইয়র্কে একটি প্রতিবাদ মিছিলে বস্ত্র শিল্প কারখানার নারী শ্রমিকরা আবারও যোগ দেন। একই সময় পৃথিবীর সর্বত্র নারীর ভোটাধিকার দাবীও বলিষ্ঠ আন্দোলনের রূপ নিতে থাকে। এই সকল ঘটনা ধারার সম্মিলনের মধ্যে দিয়েই নারীদের বিভিন্নমুখী প্রতিবাদী ভূমিকার প্রতি আন্তর্জাতিক সংহতি প্রকাশ, সমর্থন দান ও সহযোগিতার ক্ষেত্র তৈরীর প্রতীক হিসাবে একটি দিনকে চিহ্নিত করার উপলব্ধি জাগে। অত:পর ১৯১০ সালে কোপেন হেগেনে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক নারী সম্মেলনে জার্মান সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী ক্লারা জেটকিনের প্রস্তাব অনুসারে ঐতিহাসিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ তারিখ হিসাবে ৮ই মার্চকে বিশ্ব নারী দিবস ঘোষণা করা হয়।

১৯৯১ সালে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সুদীর্ঘ সংগ্রামে পাওয়া ৮ই মার্চকে আমরা কিভাবে দেখছি? আজ সামাজিভাবে নারীর অধঃস্থন অবস্থা যদিও আংশিক স্বীকৃতি পায়, নারী অবস্থানের প্রশ্নটি অস্বীকৃত থেকে যায়। নারী পুরুষের মধ্যকার অধিকারগত বৈষম্য একটি রাজনৈতিক প্রশ্ন; অর্থাৎ ক্ষমতার দ্ব›দ্ব এখানে অনিবার্য। নারীকে স্বাধীন, সচেতন ও বলিষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য যে সামাজিক রূপান্তর প্রয়োজন তা অর্জন করতে হবে আদর্শগত সংগ্রাম, নতুন দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে। এই সমস্তের ভিত্তি হিসেবে প্রয়োজন নারী পুরুষের অধিকারগত সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে, এমন শক্ত আইন কাঠামো।

১৯৯১ সালের ৮ই মার্চে, তাই আমাদের দাবী নব নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্যদের কাছে আইনগত অধিকার নিয়েঃ
১। ধর্মভিত্তিক ব্যক্তিগত আইন নয়, নারী-পুরুষের সমান অধিকারের ভিত্তিতে সার্বজনীন দেওয়ানী আইন প্রণীত হোক। পারিবারিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অর্থাৎ বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদ, সন্তানের অভিভাবকত্ব, সম্পত্তির উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে সমান অধিকার ভিত্তিক আইন প্রণয়ন করা হোক;
২। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮ নং অনুচ্ছেদের ১ নং ধারা সংশোধন করে পারিবারিক ও জনজীবনের সকল ক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করা হোক;
৩। কর্মক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমানাধিকারের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সনদ অনুযায়ী ও দেশের শ্রম আইনের আলোকে শ্রমজীবি নারীর সংগঠিত হওয়ার অধিকার, সমান কাজে সমান জরুরী, মাতৃকল্যাণ ছুটি ও ভাতা, শিশু যতœ কেন্দ্রসহ অন্যান্য আইন বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় আইনগত ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেওয়া হোক;
৪। জাতিসংঘের ‘নারীর প্রতি সকল বৈষম্য নিরসন সনদ’-এর সম্পূর্ণ অনুমোদন ও বাস্তবায়ন রাস্ট্রীয় পর্যায়ে করা হোক। বর্তমানে এই সনদের ২, ১৩(ক) ও ১৬(গ)(চ) অনুচ্ছেদ অনুমোদন বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক অস্বীকৃত রয়েছে। অর্থাৎ এই ননদ বাস্তবায়নে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব গ্রহণ এবং পারিবারিক ক্ষেত্রে সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার অসম্মত।

৮ই মার্চ কেবল নতুন করে দাবী তোলার দিনই নয়, এই দিনটি আমাদের সংহতির দিন, আনন্দের দিন। দাবীর সাথে সাথে এই দিনটিকে আমরা উৎসবমুখর করতে চাই। এই উদ্দেশ্যে ৮ই মার্চ শুক্রবার, দল-মত নির্বিশেষে সকল নারীর অংশগ্রহণে একটি আনন্দ মিছিলের আয়োজন করা হয়েছে। আনন্দ মিছিল শেষে সংসদ ভবন-চত্বরে দাবীনামা ঘোষণা করা হবে। এবং উপস্থিত প্রত্যেকটি নারীর হাতে ছাপ সম্বলিত বিশাল প্রতিকী বন্ধুত্ব-বৃত্ত আঁকা হবে। দলে দলে নারীর যোগদান আনন্দ শোভাযাত্রা ও যাত্রাশেষে সমাবেশকে আনন্দ মুখর করবে। ৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস সকলের স্বতঃস্ফুর্ত উৎসব ও দাবীর আহŸানে মুখরিত হোক।

আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন কমিটি ১৯৯১

Pin It on Pinterest

Share This