আন্তর্জাতিক নারীদিবস- ২০১৭
দিন-তারিখ: শুক্রবার, ২৫ ফাল্গুন ১৪২৪/৯ মার্চ ২০১৮,
স্থান: আশুলিয়া স্কুল ও কলেজ প্রাঙ্গন, আশুলিয়া, সাভার, ঢাকা।
ঘোষণাপত্র
৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারীদিবস। ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ নিউ ইয়র্কের সেলাই কারখানায় বিপদজনক ও অমানবিক কর্মপরিবেশ, স্বল্প মজুরী এবং দৈনিক ১২ ঘন্টা শ্রমের বিরুদ্ধে নারী শ্রমিকরা প্রতিবাদ করে। এরপর বিভিন্ন সময়ে ৮ মার্চে উল্লেখযোগ্য আরো ঘটনার ধারাবাহিকতায় ১৯১০ সালে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক নারী সম্মেলনে জার্মান সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী ক্লারা জেটকিন এর প্রস্তাবে ৮ মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক নারীদিবস’ ঘোষণা করা হয়।
প্রতিবাদী আন্দোলনের এই ধারার সাথে একাত্ম হয়ে প্রতিবছর বাংলাদেশে বিভিন্ন নারীসংগঠন, মানবাধিকার সংগঠন জোটগত বা এককভাবে দিবসটি পালন করে আসছে। এ বছর আমরা বাংলাদেশের তৈরিপোশাক কারখানার নারী শ্রমিকদের অধিকার আদায় ও নির্যাতন হ্রাসের লক্ষ্যে গঠিত পাঁচটি সংগঠনের মিলিত উদ্যোগ ‘সজাগ’ এর মাধ্যমে দিবসটি পালন করছি। আমাদের এবারের প্রতিপাদ্য “আমাদের ডর কাহারে!”
সারা বিশ্বেই ঘরে, বাইরে, রাস্তাঘাটে, যানবাহনে, কর্মস্থলে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, কারখানায়, দুর্যোগে-দুর্বিপাকে, এমন কি আনন্দানুষ্ঠানেও সকল বয়সের, সকল শ্রেণি-পেশার নারীই সর্বদা বৈষম্য, নির্যাতন, নিপীড়ন ও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে বা হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে থাকছে। তবুও তারা থেমে নেই। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। সকল ভয়-ভীতি, বাধা-বিপত্তি ঠেলে নারী অবিরাম সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে দৃঢ় পায়ে।
আমাদের কর্মজীবী নারীদের একটি বড় অংশ তৈরিপোশাক কারখানার শ্রমিক। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী প্রধান এই খাতে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক আছে। এদের মধ্যে শতকরা ৬৫ ভাগ নারী। তারা দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে তেমনি নিজের ও পরিবারের উন্নতিতেও সহায়তা করতে পারছে কিন্তু তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি দারুণভাবে উপেক্ষিত। ঘরে, বাইরে, রাস্তায়, কলে-কারখানায় উত্যক্তকরণ, যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণ যেন তাদের জীবনের নৈমিত্তিক ঘটনা!
‘কর্মজীবী নারী’ ও ‘কেয়ার বাংলাদেশ’ এর সদ্য সমাপ্ত এক গবেষণার আওতায় মোট ১৫০ জন তৈরিপোশাক কারখানার নারী শ্রমিকের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। এদের মধ্যে শতকরা ৭৪ জন বলেছেন, বাধ্যতামূলকভাবে তাদের অতিরিক্ত সময় কাজ করতে হয় কিন্তু রাতে বাসায় ফেরার জন্য কোনরূপ যানবাহন বা নিরাপত্তার ব্যবস্থা কারখানা কর্তৃপক্ষ করেন না। শতকরা ৮৪.৭ জন বলেছেন, কারখানার ভিতরে তাদের মৌখিক নির্যাতন যথা, কটুকথা, গালিগালাজ এর শিকার হতে হয়। শতকরা ৭১.৩ জন বলেছেন, তাদের উপর মানসিক নির্যাতন করা হয়। শতকরা ২০ জন শারীরিক নির্যাতন যথা, মারধর এর শিকার হওয়ার কথা বলেছেন। যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার কথা বলেছেন শতকরা ১২.৭ জন। নারী শ্রমিকের নিরাপত্তার জন্য তো বটেই, দেশের অর্থনীতির স্বার্থেও এর প্রতিকারে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরী।
আমরা মনে করি, নারীনির্যাতন তথা শ্রমিক নারীর উপর নির্যাতন এর প্রধান কারণ নারী শ্রমিকের নিরাপত্তার বিষয়টিকে গুরুত্ব না দেয়া, নারীকে সম-মর্যাদা না দেওয়া এবং নারীর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি। এই আচরণ ও বিশ্বাস প্রকারন্তরে অপরাধীকেই প্রশ্রয় দেয়। তাই সকল কুসংষ্কার, অপচর্চা, অপব্যাখ্যা, পশ্চাৎপদতা ও ভয়-ভীতি থেকে মুক্ত হয়ে, নারীর উপর যেকোন ধরনের অন্যায় আচরণ ও সহিংসতা ঘটনার ন্যায়বিচার দাবীর সাথে সাথে এই অবস্থার বিরুদ্ধে আমাদের প্রত্যেককে রুখে দাঁড়াতে হবে। নির্যাতনের শিকার নারীর পক্ষে অবস্থান নিতে হবে।
আজকের এই সমাবেশ থেকে আমরা জোর দাবী জানাচ্ছি,
* নারীর উপর যেকোন ধরনের নিপীড়ন-নির্যাতন ও সহিংসতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান
* যৌন নির্যাতনের শিকার নারীকে দোষারোপ না করে তার প্রতি সহমর্মী হন, তাঁর পাশে দাঁড়ান
* নির্যাতনের শিকার নারী ও তার পরিবারকে আইনী পদক্ষেপ নিতে ও ন্যায়বিচার পেতে সহযোগিতা করুন
* নারীর উপর অত্যাচার, নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা প্রতিরোধে নারীকে মানুষ হিসেবে চিনতে, জানতে ও সম্মান করতে স্কুল-কলেজ, ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শিখানোর উদ্যোগ নিন
* নারী শ্রমিকের নিরাপত্তা বিধানে:
– ২০০৯ সালে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিটি কর্মস্থলে যৌন নির্যাতন ও উত্যক্তকরণ প্রতিরোধে, প্রতিকারে সুরক্ষা কমিটি গঠন ও তা কার্যকর করুন
– ‘কারখানা এবং প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর’সহ সংশ্লিষ্ঠ অন্যান্য সরকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে উচ্চ আদালতের উক্ত নির্দেশনার কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণ ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করুন
– প্রতিটি কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন এবং মালিক ও শ্রমিকগণের প্রতিনিধির সমন্বয়ে গঠিত ‘অংশগ্রহণকারী কমিটি’কে নারীনির্যাতন প্রতিরোধ ও প্রতিকারে সক্রিয় করুন
– রাতে সকল রাস্তায় পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করুন এবং সূর্যাস্তের পরে কর্মস্থল থেকে বাসায় ফেরার জন্য নিরাপদ যানবাহনের ব্যবস্থা করুন।