ঘোষণাপত্র
স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পরও মুক্তিযুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া মানুষদের মুখ আমাদের স্মৃতিতে অস্থান। হারিয়ে যাওয়া সেইসব স্বজনদের স্মরণে প্রতি বছরের মতো এবারও বিজয় দিবসের প্রাক্কালে নিবেদিত হচ্ছে নারীপক্ষ’র শ্রদ্ধাঞ্জলি “আলোর স্মরণে কাটুক আঁধার”। ১৯৮৮ সাল থেকে প্রতিবছর একটি বিশেষ বিষয়কে প্রতিপাদ্য করে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে নারীপক্ষ। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘৭১- এর যে নারীদের আমরা ভুলেছি।
আজ ৯ ডিসেম্বর, রোকেয়া দিবস। ধর্মীয় অনুশাসনের দোহাই দিয়ে, সমাজের চোখ রাঙানীর ভয় দেখিয়ে নারীকে পীড়ন করা, তাকে সকল প্রকার জ্ঞানের আলো থেকে দূরে রাখা এবং বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করে গৃহাভ্যস্তরে আবদ্ধ থাকতে বাধ্য করার চিরাচরিত প্রবণতা ও প্রথার বিরুদ্ধে যাঁর লেখনী সর্বদা সোচ্চার ছিলো, নারীমুক্তির অগ্রসৈনিক সেই সাহসী নারী বেগম রোকেয়ার আজ জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি নেই কিন্তু যে আলোকবর্তিকাটি রেখে গেছেন তা যুগ যগ ধরে নারীমুক্তির পথে আলো ছড়াবে। আমরা আজ এই অনুষ্ঠানে তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।
‘৭১- এর মুক্তিযুদ্ধ আমাদের প্রত্যেকের জীবনে যোগ করেছে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা। সেখানে মুক্তির আনন্দ এবং বীরগাঁথা যেমন রয়েছে তেমনই আছে অপরিসীম দু:খ-যন্ত্রণা, অত্যাচার-নির্যাতন, লাঞ্ছনা, আছে আপনজন হারানোর বেদনা, শারিরীক ও মানসিক প্রতিবন্ধিত্ব নিয়ে বেঁচে থাকার বিড়ম্বনা। ঐ যুদ্ধে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বহু নারী। স্বাধীনতার পরও তাঁদেরকে সইতে হয়েছে বাড়তি অপমান এবং সামাজিক-পারিবারিক তাচ্ছিল্য, বিদ্রুপ ও অবহেলা। রাষ্ট্রীয় অবহেলায়, রাজনৈতিক দল ও সুধী সমাজের মনোযোগের বাইরে, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে পরিবার ও আপনজনদের কাছ থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে এক কোণে পড়ে থাকতে তাঁরা বাধ্য হয়েছেন। ধর্ষণের শিকার হওয়ার কারণে যাঁদের গর্ভে সস্তান এসেছিলো গর্ভপাত ছাড়া আর কোন উপায় বা সুযোগ তাঁদের সামনে তুলে ধরা হয়নি। যে যুদ্ধ শিশুরা জন্মগ্রহণ করেছিলো তাদেরকেও আমরা সহজভাবে গ্রহণ করতে পারিনি।
মুক্তিযুদ্ধ যে নারীরা ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন তাঁদেরকে তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান “বীরাঙ্গনা” উপাধি দিয়েছিলেন। “শাব্দিক অর্থে বীরাঙ্গনা হচ্ছে বীরযোদ্ধা, বীরনারী, বীর্যবতী বা সাহসী নারী, অর্থাৎ অসীম সাহসী নারী যাঁরা দেশের জন্য প্রাণপাত করে লড়াই করেন। কিন্তু যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে বীরাঙ্গনা শব্দের অর্থ এবং ব্যবহার সম্পূর্ণ বিপরীত। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অসংখ্য নারী ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হন। স্বাধীনতার পর পরিবার তাঁদের ফিরিয়ে নিতে অস্বীকার করলে তাঁরা আত্নপরিচয় আর আশ্রয় আবাসনের সংকটে পড়েন। উদ্বেগ, উৎকন্ঠা, শঙ্কা, আশ্রয় ও নিরাপত্তাহীনতা এবং অন্ন-বস্ত্র, চিকিৎসা ও মর্যাদার সংকট- সব মিলিয়ে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে তাঁদের দিন কাটে। বীরাঙ্গনা শব্দের অর্থ, ধারণা ও ব্যবহারের দিকে লক্ষ্য না রেখেই বীরাঙ্গনা উপাধি দেওয়া হয়। এর ফলে তাঁরা মূলধারা হতে একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। বাংলাদেশের পুরম্নষতান্ত্রিক সমাজ-ব্যবস্থার নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী সে সময়ে তাঁদের সম্মানীত করার জন্য প্রস্ত্তত ছিলনা।” ১ বরং এই উপাধির কারণে তাঁরা হেয় প্রতিপন্ন হয়েছেন। এই উপাধি তাঁদের জন্য অসম্মান, অপমান, অপবাদ এবং লাঞ্ছনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তী চলিস্নশ বছরে তাঁরা সেই বীরের সম্মান, মর্যাদা এবং জীবন যাপনের ন্যায্য সুযোগ-সুবিধাটুকু পায়নি, এমন কি তাঁদের ওপর সংঘটিত অপরাধের বিচারও তাঁরা পায়নি।
আমাদের সমাজ-সংস্কৃতির চিরাচরিত দৃষ্টিভঙ্গি হলো, ধর্ষণ বা যে কোন ধরনের যৌন নির্যাতন নারীর ইজ্জত বা সম্ভ্রমহানি ঘটায়। পরিবার ও সমাজ নির্যাতনের শিকার নারীকেই অপমান ও অপদস্থ করে এবং তাকেই অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে। ‘৭১- এর মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার নারীদের প্রতি এই দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণ প্রতিহত করতে তাঁদেরকে প্রকাশ্যে সম্মান প্রদানের কোনও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আমাদের আজও শুনতে হয় “দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে…।” ইজ্জত-সম্ভ্রম কোনভাবেই শরীরকেন্দ্রিক নয়, তাই ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার নারীদের ইজ্জত-সম্ভ্রমের প্রশ্ন তোলা তাঁদের মর্যাদা ও সম্মান ক্ষুণ্ণ করার সামিল। আমরা যারা বীরাঙ্গনা, আমাদের ইজ্জত যায়নি, সম্ভ্রমহানি হয়নি, আমরা যুদ্ধাপরাধের শিকার, সুতরাং এই ধরনের উক্তি আমরা আর শুনতে চাই না।
চল্লিশ বছর বীরাঙ্গনাদের প্রাপ্য মর্যাদা ও সম্মান প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব পালনে সবাই ব্যর্থ। এই ব্যর্থতার গ্লানি আমাদের ব্যথিত করে, লজ্জিত করে। আমরা ক্ষমা প্রার্থী। আমরা চাই, রাষ্ট্র বীরাঙ্গনা সম্বোধনের যথাযোগ্য সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করবে।
মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার অনেক বীরাঙ্গনা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অনেকে আজ আর বেঁচে নেই, যাঁরা বেঁচে আছেন, আমরা চাই তাঁরা যেন আর্থিক স্বচ্ছলতায় ও সম্মানের সাথে জীবন যাপন করতে পারেন, সকল আড়াল ভেঙে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র, সর্বত্র সম্মান ও মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেন।
আমাদের দাবি :
- ‘৭১- এর মুক্তিযুদ্ধে নারীর ওপরে সংঘটিত ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন কোন সাধারণ অপরাধ নয়, তা যুদ্ধ অপরাধ। এই অপরাধ সংঘটনকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিচার করতে হবে
- বীরাঙ্গনাদের প্রতি সরকারী-বেসরকারী সকল পর্যায়ে লিখনে, বলনে বা ভাষণে শব্দ ও ভাষা ব্যবহারে ধর্ষিতা, ইজ্জতহানি, সম্ভ্রমহানি, ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। সকল রাষ্ট্রীয় দলিল ও কার্যক্রম থেকে “দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে …” বা “দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি …” ধরনের কথা বাতিল করে সে স্থানে সরাসরি “১৯৭১- এর মুক্তিযুদ্ধে দুই লাখ নারী ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন’ এই বাক্য ব্যবহার করতে হবে
- ‘৭১- এ বীরাঙ্গনাদের জন্য সরকারী সহায়তা, যথা সকল সরকারী হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা এবং ভাতা প্রদান যাতে তাঁরা স্বাচ্ছন্দে জীবনযাপন, সম্মান ও মর্যাদার সাথে তাঁদের পছন্দমতো স্থানে বসবাস করতে পারেন।
মুক্তিযুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের স্মরণে আজ আমরা এখানে মোমবাতির যে আলো জ্বেলেছি তা সকল অন্যায়-অবিচারের অন্ধকারকে দূর করে দেশের প্রতিটি মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার দৃঢ় প্রত্যয়ে সমুজ্জ্বল হোক। এই আলো এনে দিক ‘৭১- এর ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার নারীদের জীবনে প্রশান্তি, এই আলো ফিরিয়ে দিক “বীরাঙ্গনা” সম্বোধনে সম্মান ও মর্যাদা।
স্থান : কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার
সময় : বিকেল ৫:৩০ থেকে সন্ধ্যা ৭ :০০
তারিখ : শুক্রবার, ২৫ অগ্রহায়ণ ১৪১৮/৯ ডিসেম্বর ২০১১
১. নিবেদিতা দাশপুরকায়স্থ “বীরাঙ্গনা” জেন্ডার বিশ্বকোষ, ফারিয়া লারা ফাউন্ডেশন, ফেব্রুয়ারি ২০০৬
নারীপক্ষ
র্যাংগস নীলু স্কোয়ার (৫ম তলা), বাড়ী- ৭৫, সড়ক- ৫/এ, সাতমসজিদ রোড, ধানমন্ডি, ঢাকা-১২০৯, বাংলাদেশ
জিপিও বক্স-৭২৩, ঢাকা-১০০০, ফোন : ৮৮০-২-৮১১৯৯১৭, ৮১৫৩৯৬৭, ফ্যাক্স : ৮৮০-২-৮১১৬১৪৮
ই-মেইল : naripokkho@gmail.com, ওয়েব : www.naripokkho.org.bd
আলোর স্মরণে কাটুক আঁধার – ২০১১