১৮৫৭ সালের ৮ই মার্চ উিইয়র্ক শহরের সেলাই কারখানার নারী শ্রমিকরা তাদের অমানবিক ও বিপদজনক কর্ম পববেশ, দৈনিক বার ঘন্টা শ্রম ও স্বল্প জমুরীর বিরম্নদ্ধে একটি শমিত্ম পূর্ণ মিছিল বের করেছিলো। তাদের এই শামিত্মপূর্ণ মিছিলের উপর পুলিশ হামলা চালায়। এ তিন বছর পর ১৮৬০ সালে নারী শ্রমিকরা সংঘবদ্ধ হয়ে তাদের দাবী আদায়ের লক্ষ্যে নিজস্ব ইউনিয়ন গঠনে সমর্থন হন। নারী আন্দোলনের উত্তরোত্তর বিস্তৃতির ফলে ১৮৭১ সালে নেদারল্যান্ডস্ এর দি হেগে প্রথম যুদ্ধ বিরোধী নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯০৫ থেকে ১৯০৭ সালে রাশিয়ার রাজতন্ত্র বিরোধী সংগ্রামে অসংখ্য নারী সক্রিয ভূমিকা রাখেন। পরবর্তীতে ১৯০৮ সালের ৮ই মার্চ নিউ ইয়র্কে একটি প্রতিবাদ মিছিলে বস্ত্রশিল্প কারখানার নারী শ্রমিকরা আবারও যোগ দেন। একই সময় পৃথিবীর সর্বত্র নারী ভোটাধিকার দাবীও বলিষ্ঠ আন্দোলনে রূপ নিতে থাকে।
এই সকল ঘটনা ধারার সম্মিলনের মধ্যে দিয়েই নারীদের বিভিন্নমুখী প্রতিবাদী ভূমিকার প্রতি আন্তর্জাতিক সংহতি প্রকাশ, সমর্থন দান ও সহযোগিতার ক্ষেত্র তৈরীর প্রতীক হিসাবে একটি দিনকে চিহ্নিত করার উপলব্ধি জাগে। এরপর ১৯১০ সালে কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক নারী সম্মেলনে জার্মান সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী ক্লারা জেটকিনের প্রসত্মাব অনুসারে ঐতিহাসিক ভাবে তাৎপর্যপূর্ণ তারিখ হিসেবে ৮ই মার্চকে বিশ্ব নারী দিবস ঘোষণা করা হয়।
বাংলাদেশে নারী অধিকার আদায়ের আন্দোলনে এই দিনটির তাৎপর্য তুলে ধরার লক্ষ্যে ১৯৯১ সনে ‘‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদ্যাপন কমিটি’’ গঠন করা হয়। বিভিন্ন নারী সংগঠন ও উন্নয়ন সংস্থার সমন্বয়ে এই কমিটি বিগত দশ বছর ধরে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন করে আসছে। প্রতি বছর নারী দিবস উদ্যাপন করা হয় সামাজে নারীর অবস্থা ও অবসত্মানের একটি বিশেষ দিক সামনে রেখে সংশ্লিষ্ট দাবী সমূহ তুলে ধারার মাধ্যমে, ১৯৯১ সারের নারী দিবস কর্মসূচীর মূল বিষয়বস্ত্ত ছিল সর্বসত্মরে, সর্বক্ষেত্রে নারী-পুরম্নষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা লক্ষ্যে আইন সংস্কারের দাবী। ১৯৯২ সালের বিষয়বস্ত্ত ছিল নারীর প্রতি সব ধরনের নির্যাতন, অত্যাচার ও অপরাধকে মানবাধিকার লংঘন হিসেবে চিহ্নিত করা। ১৯৯৩ সনে আমাদের দাবী ছিল বিচার ব্যবস্থায় আমূল সংস্কারের। ১৯৯৪ সনের দাবী নারীর শরীরের উপর নিজের অধিকার স্থাপন। ১৯৯৫ সনে নারী দিবস উদ্যাপনের বিষয় ছিল আন্তর্জাতিক নারী সংহতি। ১৯৯৬ সনে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বৈষম্য উন্মাচন করে নারী দিবস উয্যাপন করা হয় সমতার দাবীতে। ১৯৯৭ সনে কিশোরীদের জন্য বৈষম্য মূক্ত ও নিরাপদ পরিবেশের দাবীতে নারী দিবস পালন করা হয়। ১৯৯৮ সালের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল স্বাধীন ভাবে পথ চলবো, নিজের কথা নিজে বলবো। ১৯৯৯ সনে ছিল পরিবার থেকে রাষ্ট্রের প্রতিটি পর্যায়ে নারী পুরম্নষের সমান অধিকারের দাবী। ২০০০ সালের জন্য সকলের প্রতি দাবী ছিল সারা দেশময় যে নারী নিযাতন চলছে, তার প্রতি রম্নখে দাঁড়ানোর জন্য।
গত দশ বছর ধরে আমরা সম্মিলিত ভাবে যে দাবীগুলো উচ্চারণ করেছি তা সুনির্দিষ্টভাবে কোন সরকার কোন সংগঠন বা কোন ব্যক্তির কাছে নয়। এগুলো ছিল সম্মিলিতভাবে জনমত তৈরীর হাতিয়ার। আমরা চেয়েছি, যুগ যুগ ধরে এদেশের নারী সমাজ তাদের যে সব প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে এসেছে, সেই সব বঞ্চনার কথা নারী-পুরম্নষ সবাই নাজুক। সবাই সচেতন হোক সোচ্চার হোক নারীর অধিকার আদায়ের জন্য।
কালের গতিতে পৃথিবীর মানুষ এখন একবিংশ শতাব্দী অতিক্রম করছে। কিন্তু এখনও এদেশের নারী সমাজের নির্যাতন এবং বঞ্চনার ভয়াবহ চিত্র আমাদের শিহরিত করে তোলে। নারীর অবস্থানকে ছোট করে দেখা, পারিবারিক সিদ্ধামত্ম গ্রহণে নারীর অংশগ্রহণকে গুরম্নত্ব না দেয়া, সামাজিক ও পারিবারিক ভাবে নিরাপত্তাহীনতা, জাতীয় রাজনীতিতে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণের প্রতিবন্ধকতা, ইত্যাদি বিষয়াবলী নারীকে খেনো বেষ্টিত করে আছে। এ বছর আবারো আমরা নির্বাচনে যাচ্ছি। ইতিমধ্যে নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণ জোরদার করার জন্য নারী আন্দোলনের পক্ষ থেকে দাবী করা হয়েছে সংসদে নারীর জন্য সংরক্ষিত আসন সংখ্যা বৃদ্ধি ও এই আসনে সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা। রাজনৈতিক দলগুলো এ ব্যাপারে কোন নীতিবাচক সাড়া আজও দেয়নি এবং সংসদ এ ব্যাপারে একেবারেই নিশ্চুপ।
অতএব, আমরা এক সময় বুঝতে পারলাম আমাদের সমস্যা আর দাবীর কথাগুলো আমাদেরই বলতে হবে। সমাধানের পথও আমাদেরই খুঁজতে হবে। আমরা-অর্থাৎ এদেশের অগ্রগামী নারী সংগঠনগুলো সোচ্চার হলাম। তৈরী হলো আন্তর্জাতিক নালী দিবস উদ্যাপন কমিটি। গত দশ বছর ধরে আমরা এই কমিটি থেকে সাড়ম্বরে র্যা লী করে, মশাল মিছিল করে, শ্লোগান দিয়ে, প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই দিনটিতে আমাদের নির্ধারিত দাবীগুলো জানিয়ে আসছি।
দশ বছরের প্রচেষ্টায় কতটুকু সফলতা লাভ করেছি তার সূক্ষ বিচার বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। তবে এইটুকু বেশ জোর গলায় বলা যায় যে সর্বসত্মরের মানুষের মধ্যে এই দিনটি সম্পর্কে একটি সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। অমত্মত:পক্ষে ৮ই মার্চ দিনটি যে নারী অধিকার আদায়ের দাবী জানাবার জন্য একটি নির্দিষ্ট দিন-এটি এখন অধিকাংশ মানুষই জানে। এই সচেতনতাই হলো যে কোন উন্নয়নের পূর্বশর্ত। তাছাড়া এখন সমত্মানের যে কোন পরিচিতিতে বাবার পাশাপাশি মায়ের নাম লেখাও বাধ্যতামূলক।
যেকোন বড় পরিবর্তনই সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের পর অভীষ্ট লক্ষ্যে একদিন পৌঁছা যায়। আমরাও আশা করছি, আমাদের উচ্চারিত দাবীগুলি যেদিন এদেশের প্রতিটি নারীর সরব দাবী হয়ে উঠচে, সেদিন আমরা মুক্তির পথ পাব। বহু ক্রন্দন জমেছে, হয়েছে রক্তক্ষয়। আমাদের আন্দোলন এখন স্বীকৃতি পেয়েছে সামাজিক আন্দোলনে। জয় আমাদের সুনিশ্চিত।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন কমিটি
নারীপক্ষ
র্যাংগস নীলু স্কোয়ার (৫ম তলা), সড়ক- ৫/এ, বাড়ী- ৭৫, সাতমসজিদ রোড, ধানমন্ডি, ঢাকা-১২০৯, বাংলাদেশ।
জিপিও বক্স-৭২৩, ঢাকা-১০০০, ফোন : ৮৮০-২-৮১১৯৯১৭, ৫৮১৫৩৯৬৭, ফ্যাক্স : ৮৮০-২-৮১১৬১৪৮
ই-মেইল : naripokkho@gmail.com, ওয়েব : www.naripokkho.org.bd