Select Page
২০১৯-১২-১০
আলোর স্মরণে কাটুক আঁধার- ২০১৯

আনন্দ, বেদনা ও বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। এই বিজয়ের জন্য আমাদের অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে, হারাতে হয়ছে অসংখ্য স্বজন। হারিয়ে যাওয়া সেই স্বজনদের স্মরণে নারীপক্ষ ১৯৮৮ সাল থেকে বিজয় দিবসের প্রাক্কালে একটি নির্দিষ্ট প্রতিপাদ্য নিয়ে “আলোর স্মরণে কাটুক আঁধার” অনুষ্ঠান আয়োজন করে আসছে। এবারের প্রতিপাদ্য “স্বাধীনতা কে পেলো!”

’৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ’৬৯ এর গণÑঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭১- এ ৯ মাস সশস্ত্র যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বরে বিজয়ের মধ্য দিয়ে আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেছি। একটি সার্বভৌম ভূখন্ড, পতাকা ও মানচিত্র পেয়েছি। আকাক্সক্ষা ছিল, এই বিজয় আমাদের সম-মর্যাদা, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, চলাফেরার স্বাধীনতা, কথা বলা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা দেবে; আমরা ক্রমশঃ একটি শোষণ-বৈষম্যহীন ‘মুক্ত মানুষের মুক্ত সমাজ’ এর দিকে এগিয়ে যাব কিন্তু স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর আমাদের সামনে এই প্রশ্নটিই ঘুরে-ফিরে আসে, আপামর জনগণ কি এর কোনটিই পেয়েছে? তাহলে এই স্বাধীনতার অর্থ কি? কে পেলো স্বাধীনতা?

জাতীয় অর্থনীতিতে মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ বেড়েছে কিন্তু অর্জনের সিংহভাগ ভোগ করছে দেশের গুটিকতক ধনীকশ্রেণি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো- এর ২০১৬ সালের তথ্য অনুযায়ী মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি)- এর ৩৮% ভোগ করে একেবারে উপরের দিকের মাত্র ১০% উচ্চবিত্ত মানুষ এবং একেবারে নিচের দিকে ১০% নি¤œবিত্ত মানুষ ভোগ করে মাত্র ১%। একদিকে এই অর্থনৈতিক বৈষম্য, অপরদিকে আইনের শাসনের অভাব ও দুঃশাসন, বিচারহীনতা, দলীয় রাজনীতির নির্লজ্জ আগ্রাসন, ক্ষমতাসীনদের অবৈধ ও অনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি এবং সমাজ ও প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতির কারণে দেশ এক অরাজক অবস্থায় পতিত হয়েছে। এর বিরুদ্ধে কথা বললে বা মত প্রকাশ করলে জীবনের উপর নেমে আসে চরম অত্যাচার-নির্যাতন, হুমকি-ধমকি, গুম, অপহরণ এমনকি হত্যা। এই অবস্থার ভুক্তভোগী দেশের প্রতিটি সাধারণ মানুষ। নারীর অবস্থা আরও ভয়াবহ।

নারী আজ রাজনীতি, অর্থনীতি, খেলাধুলা, পর্বতারোহন থেকে শুরু করে প্রশাসন, বিচারবিভাগসহ প্রায় সকল ক্ষেত্রে স্ব-মহিমায় প্রতিষ্ঠিত। সকল পেশার সকল স্তরে নারী জায়গা করে নিয়েছে। পরিবার থেকে রাষ্ট্র অবধি স্থানীয় থেকে জাতীয় অর্থনৈতিক অর্জনে নারী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে অথচ এর যথাযথ স্বীকৃতি নেই বললেই চলে। সম্পত্তিতে, সন্তানের অভিভাবকত্বে নারীর অধিকার সীমিত; এমনকি তার নিজের উপার্জিত অর্থ-সম্পদের উপরও তার নিয়ন্ত্রণ নেই। নারী তার সন্তানের স্বাভাবিক অভিভাবক নয় বরং নারীকে আজীবন একজন পুরুষের অধীনে থাকতে হয়। সকল ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মধ্যে চরম বৈষম্য বিরাজমান। ব্যক্তিনারী সর্বদা পরাধীন ও অধিকারবঞ্চিত। আইনী বাধা না থাকলেও চলাফেরার স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা নারীর নেই এবং নারীর নিরাপত্তা চরমভাবে বিঘিœত বা বলতে গেলে শূণ্যের কোঠায়! ঘরে, বাইরে, রাস্তাঘাটে, যানবাহনে, কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারী প্রতিনিয়ত ধর্ষণ, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, ধর্ষণচেষ্টা, যৌন হয়রানি, উত্যক্তকরণ, এসিড আক্রমণসহ নানাবিধ সহিংসতার শিকার হচ্ছে। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, এমনকি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তির কাছেও সে নিরাপদ নয়। এর মূল কারণ নারীকে মানুষ হিসেবে গণ্য না করার দৃষ্টিভঙ্গী ও আচরণ। আদিকাল থেকে সমাজের চিন্তা-চেতনা ও বিধি-বিধান নারীকে অধঃস্থন অবস্থানে রেখেছে। নারীবিদ্বেষী দৃষ্টিভঙ্গী ও সংস্কৃতি একদিকে নারীর উপর সহিংসতা করার প্রবণতা তৈরি করে, অন্যদিকে নির্যাতনের শিকার নারীকেই দোষারোপ করে।

বহু নারী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে যুক্ত ছিলেন; অথচ মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা, অংশগ্রহণ এবং তাদের উপর নির্যাতনের বিষয়গুলো যথাযথভাবে গুরুত্ব পায়নি। মুক্তিযুদ্ধে লক্ষাধিক নারী ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণ ও যৌন আক্রমনের শিকার নারীর শারীরিক, ও মানসিক ক্ষতি এবং সামাজিক প্রতিবন্ধকতা ও বিড়ম্বনা কখনোই আমলে নেয়া হয়নি বরং সরকারি-বেসরকারি সকল পর্যায়ে কেবল তাঁদের ইজ্জত হানির কথাই উত্থাপিত হয়েছে বার বার, বহুবার; যা মর্যাদা হানিকর ও অসম্মানজনক।

অর্থাৎ নারী মানুষ হিসেবে, নাগরিক হিসেবে সম-মর্যাদা পায়নি। তাহলে, এই স্বাধীনতা নারীকে কী দিলো? নারী কী পেলো এই স্বাধীনতা থেকে?

এই অবস্থা থেকে আমাদেরকে মুক্ত হতেই হবে। স্বাধীনতা কোন ব্যক্তি বা দলের একার নয়। দেশের প্রতিটি নাগরিক যাতে স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে পারে, নিরাপদে বাঁচতে পারে, অর্থনৈতিকভাবে মুক্ত হতে পারে, নির্বিঘেœ চলাফেরা করতে পারে, নিজের কথা বলতে ও মত প্রকাশ করতে পারে এরজন্য আমাদের প্রত্যেককে সক্রিয় হতে হবে।

আসুন, নারীপক্ষ আয়োজিত “আলোর স্মরণে কাটুক আঁধার” অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের স্মরণে একটি করে মোমবাতি জ্বালাই এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বলীয়ান হয়ে প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হই।

স্থান: কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার
দিন-ক্ষণ : মঙ্গলবার, ২৫ অগ্রহায়ণ ১৪২৬/১০ ডিসেম্বর ২০১৯, বিকাল ৫:২০ থেকে সন্ধ্যা ৬:৩০

নারীপক্ষ
জিপিও বক্স-৭২৩, ঢাকা-১০০০, www.naripokkho.org.bd

Pin It on Pinterest

Share This