৩০ অগ্রহায়ণ ১৪২৭/১৫ ডিসেম্বর ২০২০ রাত ৮ টায় মুক্তিযুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের স্মরণে নারীপক্ষ’র আয়োজনে ‘আলোর স্মরণে কাটুক আঁধার’ অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৮৮ সাল থেকে প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসে বিজয় দিবসের প্রাক্কালে মুক্তিযুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের স্মরণে বিভিন্ন প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে নারীপক্ষ নিয়মিতভাবে “আলোর স্মরণে কাটুক আঁধার” অনুষ্ঠানটি উদ্যাপন করে আসছে। এবারের প্রতিপাদ্য “মুক্তিযুদ্ধ ও ইহজাগতিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন”।
এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে ‘আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রাণে’ গানের সাথে সাথে প্রতিকী মোমবাতি প্রজ্জ্বলনের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের স্মরণে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়। অনুষ্ঠানে ঘোষণাপত্র পাঠ করেন নারীপক্ষ’র সদস্য রেহানা সামদানী। গান পরিবেশন করেন অনিমা মুক্তি, আবৃত্তি করেন ইকবাল আহমেদ, স্মৃতিচারণ করেন মুক্তিযোদ্ধা মো: শফিকুল ইসলাম, মুক্তিযোদ্ধা শাহীন আনাম, মুক্তিযোদ্ধা মোঃ মাশরুকুর হক এবং বীরাঙ্গনা রোকেনা বেওয়া।
স্মৃতিচারণের সময় মুক্তিযোদ্ধা মো: শফিকুল ইসলাম বলেন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের কিছু ঘটনা। তিনি আহ্বান জানান, নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তি যুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানানোর ব্যবস্থা করা হোক যেন ভবিষ্যতে কোন রকম ধর্ম, সংস্কৃতি, গান নিয়ে কোন রকম ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টি হওয়ার সুযোগ না থাকে। আরো বলেন, এখনও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে মানুষকে অনেক কিছু জানানো হয়নি। অনেক কিছু অমিমাংশিত রয়েছে, আরো অনেক ঘটনা রয়েছে। বাংলাদেশকে আমরা আমাদের দেশ বানাতে চই, ধর্ম, সংস্কৃতি অন্যান্য নিয়ে বিতর্ক যেন না হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়েই বাঁচতে চাই। মুক্তিযোদ্ধা শাহীন আনাম বলেন, আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি কিন্তু শহীদ রুমীর স্বপ্ন আমরা আমাদের দেশকে আমাদের মতো করে গড়ে তুলবো তা আজও পূরণ হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের কিছু ঘটনার সাথে যুদ্ধের প্রতিটি দিনের ঘটনা যেন মনে আছে, মনে একেবারে গেথে আছে, এভাবে তিনি বর্ণনা করেন। মুক্তিযোদ্ধা মোঃ মাশরুকুর হক তিনি স্মৃতি চারণকালীন সময় বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ফলে আমরা একটা স্বাধীন জাতি হিসাবে বিশ্বে মাথা উচু করে আছি এটাই আমার পরম পাওয়া। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের ঘটনা বর্ণনা করেন, বিশেষকরে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার ঘটনা বর্ণনা করেন, যুদ্ধে প্রশিক্ষণ সম্পর্কেও বর্ণনা করেন। রাজশাহীর চারঘাটের বীরাঙ্গনা রোকেনা বেওয়া বলেন সরকারের কাছে আমাদের দাবী আমরা যেন সম্মানের সাথে বাঁচতে পারি এবং এখন আমাদেও বয়স হয়েছে, এই বয়সে যেন আমরা ভালোভাবে চলতে পারি তার একটা ব্যবস্থা করে। নারীদের ক্যাম্পে আটকে রাখার ঘটনা ও রাজাকারদের কিছু ঘটনা বলেন। পাকবাহিনীর নৃশংসতার কথা ও তাঁর বিয়ে ও জীবনের অন্যান্য ঘটনা বলেন। চারঘাটে যে ক্ষতির হয়েছে তাও বর্ণনা করেন। এলাকার যুবকদের কিভাবে মারা হয়েছে তাও বর্ণনা করেন। সরকারের কাছে চলাফেরার জন্যও দাবি করেন। অংশগ্রহণকারীরা অনেকে তাঁকে মেসেজের মাধ্যমে স্যালুট জানায়।
ইহজাগতিক রাষ্ট্রের মূল বিষয় হচ্ছে, রাষ্ট্রের সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক থাকবে না। রাষ্ট্র একটি রাজনৈতিক, আইনি ও প্রশাসনিক কাঠামো। এর কোন ধর্ম থাকতে পারে না, ধর্ম মানুষের বিশ্বাস। রাষ্ট্র পরিচালিত হবে সংবিধান মোতাবেক, কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে নয়।
একটি রাষ্ট্রে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ বাস করে, এমনকি ধর্ম বিশ্বাসহীন মানুষও বাস করে। একজন ব্যক্তি যেকোনো ধর্ম পালন করার যেমন অধিকার রাখে অন্য আরেকজন ধর্ম পালন না করারও অধিকার রাখে। ধর্ম পালন করা কিংবা না করা ব্যক্তির নিজস্ব বিষয়। রাষ্ট্রে বসবাসকারী সকলের প্রধান পরিচয় রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে। সকল নাগরিককে রাষ্ট্র সমান চোখে দেখবে।
সরকারের কাছে আমাদের দাবি:
* মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে বাংলাদেশকে ইহজাগতিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধন করুন, সংশ্লিষ্ট সকল আইন সংস্কার করুন
* দেশে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারী সকল তৎপরতা বন্ধে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিন
* সমাজে ধর্মনিরপেক্ষ পরিবেশ সৃষ্টি ও অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গী গঠনে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে গুরুত্ব দিয়ে পাঠ্যক্রম প্রণয়নসহ বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিন
* প্রতিটি নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তা বিধানে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করুন, গণতন্ত্র বিনির্মাণ ও চর্চা নিশ্চিত করণে স্থায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করুন।
আমাদের আকাক্সক্ষা, ব্যক্তি লালন করবে অসাম্প্রদায়িক মনোভাব, বিরাজ করবে ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ ব্যবস্থা এবং প্রতিষ্ঠিত হবে একটি ইহজাগতিক রাষ্ট্র।
নারীপক্ষ’র সদস্য কামরুন নাহার এর ধন্যবাদ জ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হয়।